প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর নান্দনিক কারুকাজে নতুন রূপ পেয়েছে শেরপুর সীমান্তের গজনী অবকাশ পর্যটন কেন্দ্র। ঝিনাইগাতী উপজেলায় গারো পাহাড়, নদী আর ঝরণায় গড়ে ওঠা এ পর্যটন কেন্দ্র এখন অনেকটাই তার রূপ বদলে দিয়েছে। সেইসাথে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন ভ্রমণপিপাসুদের ঢল নামছে।
ইতোমধ্যে পাহাড়ি সৌন্দর্যের সাথে যোগ হয়েছে কৃত্রিমভাবে নির্মাণ করা অবকাঠামো আর মনোমুগ্ধকর নানা ভাস্কর্য বিনোদনের অনেক কিছু। পর্যটকরাও বলছেন, আগের তুলনায় অনেকটাই বদলে গেছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা হয়েছে গজনী অবকাশের লেকে দৃষ্টিনন্দন ভাসমান সেতু, লেকের পাশে সুবিশাল ওয়াটার কিংডম ও একটি প্যারাট্রবা (চরকি)। এছাড়া ঝুলন্ত ব্রিজ, ক্যাবল কার, জিপলাইনিং তো রয়েছেই। চোখে পড়ার মতো সব কিছু দেখে মুগ্ধ পর্যটকরাও। সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে পর্যটক, ইজারাদার, দোকান মালিক ও প্রশাসনের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
প্রকৃতি প্রেমীদের মনে দোলা দেয় নিশ্চিন্তে। এই নৈসর্গিক গজনীকে গত এক বছরে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সাঁজানো হয়েছে আরো নতুন রুপে। পাহাড়ের বুক জুড়ে নির্মাণ হয়েছে সুদীর্ঘ ওয়াকওয়ে। পায়ে হেটে নেয়া যাবে পাহাড়ের স্পর্শ। লেকের পাড় দিয়ে হেটে যাওয়া যাবে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে। চূড়ায় তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিক জলপ্রপাত। নীচে পাথরের স্তপ। পাথরের ওপরে বসে জমে বন্ধু বান্ধবীদের আড্ডা। ওয়াকওয়ে আর লেকের পাশে মিনি চিড়িয়াখানা। এখানে আনা হয়েছে মেছো বাঘ। সেই সাথে যোগ হয়েছে অজগর সাপ, হরিণ ও বানরসহ ৪০ প্রজাতির প্রাণী। ঘুরে বেড়ানোর জন্যে সাম্পান নৌকা। গল্প আর গানে পর্যটকদের মনে জায়গা করবে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। পড়ন্ত বিকেলে এখানকার দৃশ্য হয়ে ওঠে আরও মনোমুগ্ধকর। যা মনের স্মৃতি ফলকে জেগে থাকবে অনেক দিন।
পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে গারো মা ভিলেজ। যার ছোঁয়ায় ফুটেছে নতুনত্ব। পাশেই মাশরুম ছাতা। নিচে পাখি বেঞ্চে বসে জানা যাবে আদিবাসীদের জীবনযাত্রা। দেখা যাবে দিগন্তজুড়ে ধান ক্ষেত আর উচুঁ নিচু অসংখ্য পাহাডি টিলা। চোখে পড়বে পাহাড়ি জনপদ। সহজেই উপভোগ করবে এদের জীবনমান। শিশু দর্শনার্থীদের রয়েছে নানা কারুকার্য্য আর বিনোদন। রয়েছে চুকোলুপি চিলড্রেন পার্ক। পাশে শিশু কর্নার। এখানেই প্রদর্শিত হচ্ছে পর্যটনের আনন্দে, তুলশীমালার সুগন্ধে-শেরপুর শ্লোগানে জেলা ব্র্যান্ডিং কর্ণার। জেলা ব্র্যান্ডিং এ কর্নারে থাকছে শেরপুরের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্বলিত ছবি, বই ও ভিডিও চিত্র। জেলা ব্র্যার্ন্ডিং তুলশীমালা চালের নিদিষ্ট স্থান। এবার গজনী অবকাশকে আরও আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে আনা হয়েছে চমকপ্রদ নতুন নতুন উদ্যোগ। এর মধ্যে মন কেড়েছে ক্যাবল কার।
ভ্রমণপিপাসুরা ক্যাবল কার দিয়ে ঘুরছেন এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে। এছাড়াও ঝুলন্ত ব্রিজ, ভাসমান ব্রিজ, রুফওয়ে, প্যাডেল বোট ও সাম্পান নৌকা। এসব কিছুই মনকে নাড়া দিচ্ছে দর্শনার্থীদের। ভিন্ন মাত্রায় নিত্য-নতুন সংযোজনে শীতের শুরু থেকেই বেড়েছে পর্যটকদের সংখ্যা।
পাহাড়ের বন বাগানের সারি সারি বৃক্ষ, লাল মাটির উচুঁ পাহাড়, গহীন জঙ্গল আর পাহাড়ের কান্নার ছন্দ তোলা ঝরণা পর্যটকদের আকৃষ্টের মাঝে যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা।
প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে সংযোজন হয়েছে কৃত্রিম স্থাপনা ও ভাস্কর্য। মৎস্য কন্যা বা জলপরী, ডাইনোসর, ড্রাগন ট্যানেল, দন্ডায়মান জিরাফ, পদ্ম সিঁড়ি, লেক ভিউ পেন্টাগন, হাতির প্রতিকৃতি, স্মৃতিসৌধ, গারো মা ভিলেজ, ওয়াচ টাওয়ারসহ সবই অন্যতম। রয়েছে ক্রিসেন্ট লেক। লেকের ওপর রংধনু ব্রিজ, কৃত্রিম জলপ্রপাত, শিশু পার্ক, কবি নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিফলক। এছাড়াও রয়েছে মাটির নিচ দিয়ে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাওয়ার জন্য ড্রাগন টানেল। এর মুখে পাতালপুরী, লাভলেইন আর কবিতাবাগ। অবকাশের অন্যতম আকর্ষন সাইট ভিউ টাওয়ার। এর উচ্চতা ৮০ফুট। এর ওপর থেকে দেখা যায় মেঘালয়ের অনেক কিছু। নিচে দেখা যায় পাহাড়ি টিলার বৈচিত্রময় অপরূপ দৃশ্য।
গজনী অবকাশে ইতোমধ্যে স্থাপন করা হয়েছে মানসম্মত খাবার হোটেল। গারো পাহাড় ঘুরে ক্লান্ত হলে পাবেন কোমল পানি, কফি, ফাস্টফুড ও দুপুরের খাবার। এছাড়াও আগতদের জন্যে রয়েছে রান্নার সুব্যবস্থা। শীতের পদচারণার সাথে সাথে বেড়েছে পর্যটকদের সংখ্যা। প্রতিদিনই আসছে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা। এখানে ঘুরতে আসা পর্যটক শিউলী ম্রং, রনিতা মৃ, মঙ্গল সাংমা, সজিব মিয়া ও আনোয়ার হোসেনসহ অনেকের সাথে কথা হয়।
তারা বলেন, এসেছি মধুপুর থেকে। এখানে এসে ধারণাটাই পাল্টে গেছে। এখানকার সৌন্দর্য দেখে মন ভরে গেছে। ফিরে গেলেও এখানকার মনোরম দৃশ্য কখনোই ভুলবো না। তাদের মতে, এখানে নিরাপত্তার ব্যবস্থাও ভাল। মন খুলে বেড়ানো যায়। তারা আরও জানান, তারা আগেও এসেছেন। তবে এতো সুন্দর ছিল না। এটিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে কিছু কারুকার্য করায় সৌন্দর্যে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। তবে মধুপুর থেকে আসা নাট্যকার ফরহাদ আলী আক্ষেপ করে বলেন, এখানে থাকার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। আবাসিক হলে একদিন ভোরের সূর্যটা দেখা যেত। দেখতে পারতাম আরো অনেক কিছু।
গজনী অবকাশের গাড়ি পার্কিংয়ের ইজারাদার মো. ফারুক বলেন, গত দু’বছর লোকসান হয়েছে। এবার লোকসান পুষিয়েও লাভ হবে। তার মতো সেখানকার ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানের সৌন্দর্যটা মানুষ জানতে পারলে অবশ্যই আরও লোকের সমাগম ঘটবে।
এ ব্যাপারে শেরপুরের জেলা প্রশাসক সাহেলা আক্তার বলেন, শেরপুরের গজনী অবকাশ ভ্রমণপিপাসুদের কাছে খুবই পছন্দের একটি জায়গা। ‘পর্যটনের আনন্দে, তুলসীমালার সুগন্ধে শেরপুর’ এ জেলা ব্র্যান্ডিং শ্লোগানকে সামনে রেখে পর্যটনের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে জেলা প্রশাসন। এরই ধারাবাহিকতায় নতুন নতুন স্থাপনা ও বিভিন্ন রাইড সংযোজনের মাধ্যমে গজনী অবকাশকে পর্যটক ও ভ্রমণপিয়াসীদের নিকট আরো আকর্ষণীয়ভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, পর্যটকদের রাত্রিযাপনের জন্য মোটেল তৈরি ও ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাব পাশ হলেই রাত্রি যাপনের সুযোগ হবে পর্যটকদের।