বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি,আনন্দের পর উদ্বেগে শিক্ষার্থী-অভিভাবক
এইচএসসি পরীক্ষা না হওয়ায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা খুশি হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে নতুন উদ্বেগ* ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি নিয়ে ১৫ অক্টোবর বৈঠক করবে ইউজিসি
অনলাইন ডেস্ক: করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এ বছর পরীক্ষা ছাড়াই জেএসসি ও এসএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে এইচএসসির ফল নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বেশ খুশী হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে তাদের মাঝে নতুন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। কারণ কোন পদ্ধতিতে এ ফলাফল প্রকাশ করা হবে এবং পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে তা কতটুকু প্রভাব ফেলবে এসব বিষয় এখনও অজানা রয়ে গেছে। তাছাড়া জেএসসি ও এসএসসির ফলাফলের গড়ের মাধ্যমে এইচএসসির ফল নির্ধারণের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষার জন্য একটি কমিটি রয়েছে ইউজিসির। শিগগিরই বৈঠক ডেকে চলতি করোনা পরিস্থিতিতে কীভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া যায় সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। এরপর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নিয়ে বৈঠক করব। তিনি বলেন, আমরা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার দিকেই এগোচ্ছি। ইউজিসি সূত্রমতে, ১৫ অক্টোবর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
নিয়ে একটি বৈঠক আছে। সেখানে ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতির বিষয়টি আলোচনা হতে পারে। বাংলাদেশে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়, কোনো শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা আছে কি না। আর অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফলও নির্ভর করে এ দুই পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের ওপর।
পাশাপাশি ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিকেলে পড়তে চাইলে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিতের মতো কয়েকটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ন্যূনতম গ্রেড প্রয়োজন হয়। তাই পরীক্ষা না নিয়ে জেএসসি ও এসএসসির ফলের ওপর ভিত্তি করে এইচএসসির ফলাফল দেওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে জটিলতা তৈরির আশঙ্কা আছে বলে মনে করছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
সংশিষ্টরা জানান, বর্তমান নিয়মে বাংলাদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পাওয়া মোট নম্বরের ৪০ শতাংশ এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়ে থাকে। তাই এই নিয়মে ভর্তি পরীক্ষা হলে শিক্ষার্থীদের যথাযথ মূল্যায়ন হবে না।
সূত্রমতে, এসএসসির ১০ শতাংশ, এইচএসসির ৩০ শতাংশ ও ভর্তি পরীক্ষার ৬০ শতাংশ নিয়ে পরীক্ষার ফলাফল নির্ধারণ করা হতো। কিন্তু এবার এইচএসসি পরীক্ষা না হওয়ায় ওই ৩০ শতাংশ আর থাকছে না, কাজেই ভর্তি পরীক্ষার ওপর জোর বেশি দিতে হবে।
এইচএসসির ফল এসএসসি ও জেএসসির ফলের গড়ের মাধ্যমে হওয়ায় ভর্তি পরীক্ষায় এইচএসসির ফল গণনা করা যুক্তিযুক্ত হবে না বলে মনে করেন অনেকে। জেএসসি পর্যায় পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর একই বিষয় পড়তে হয়। এসএসসিতে বিভাগ আলাদা হওয়ার পাশাপাশি আলাদা আলাদা বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয় বলে এইচএসসির সব বিষয়ের ফল এই দুই পরীক্ষার গড়ের মাধ্যমে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, যে বয়সে শিক্ষার্থীরা জেএসসি পরীক্ষা দেয়, সে বয়সে তাদের মানসিক পরিপক্বতা আসে না। ওই পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে এইচএসসির ফল নির্ধারণ করা যুক্তিসঙ্গত বা বিজ্ঞানসম্মত নয়। তবে যেসব শিক্ষার্থী এসএসসি থেকে এইচএসসিতে বিভাগ পরিবর্তন করেছে, তাদের ফল নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জটিলতা তৈরি হবে। কারণ, কেউ হয়তো এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে ছিল, কিন্তু এইচএসসির সময় পরিবর্তন করে মানবিক বিভাগ নিয়েছে। ওই বিভাগের নম্বরের ভিত্তিতে বর্তমান বিভাগে ফলাফল দেওয়া হলে তা একেবারেই যুক্তিযুক্ত হবে না।
আর এ জটিলতার ফলে সরকারি প্রকৌশল এবং মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষায় যোগ্যতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া এইচএসসি পরীক্ষার পর যেসব শিক্ষার্থী দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চান, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা বলেন, যেহেতু এইচএসসিতে পরীক্ষা হচ্ছে না তাই জেএসসি ও এসএসসিতে ভালো জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীরা ভালো প্রস্তুতি না নিয়েও এইচএসসিতে ভালো জিপিএ পাবে। তাই এই জিপিএকে ভর্তি পদ্ধতিতে আমলে না নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
তবে এ বিষয়ে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মো. জিয়াউল কবির দুল গতকাল শুক্রবার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে এইচএসসি পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানাই। সন্তানদের নিরাপত্তার জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে না।
তিনি বলেন, জেএসসি ও এসএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে এইচএসসির ফলাফল কীভাবে নির্ধারণ হবে তা সরকার এখনও বলেনি। সরকার ভালো সিদ্ধান্তই নেবে বলে আশা করি। তবে যেভাবেই এ ফলাফল নির্ধারণ হোক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্তই আসুক না কেন আমরা তাকে সাধুবাদ জানাব।
এদিকে এইচএসসির ফল নির্ধারণ সংক্রান্ত একটি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়াউল হক জানিয়েছেন, ঠিক কোন নীতি অনুসরণ করে ফলাফল নির্ধারিত হবে সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া না হলেও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, কীভাবে জেএসসি পরীক্ষা ও এসএসসি পরীক্ষার বিষয়গুলো যুক্ত করে এইচএসসির বিষয়গুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়, তা নিয়ে পরামর্শক কমিটির পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব টেকনিক্যাল কমিটিও কাজ করছে। এসএসসি থেকে এইচএসসিতে যেসব শিক্ষার্থী বিভাগ পরিবর্তন করেছে, তাদের বিষয়টিও পর্যালোচনা করছে কমিটি।
তিনি বলেন, শুধু বিজ্ঞান থেকে মানবিক বা ব্যবসা শিক্ষায় নয়, কারিগরি শিক্ষা বা মাদ্রাসা থেকে সাধারণ শিক্ষায় যোগ দেয় শিক্ষার্থীরা। আবার প্রাইভেট, মান উন্নয়ন শিক্ষার্থীও আছে। এই প্রতিটি ক্ষেত্রই আমরা শনাক্ত করেছি এবং একটার সঙ্গে আরেকটাকে সম্পৃক্ত করতে যা করা দরকার তা নিয়ে কাজ করছি।
তবে এইচএসসি পরীক্ষা না নেওয়া হলেও বিদেশে পড়ালেখা করতে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই শিক্ষার্থীরা সমস্যার মধ্যে পড়বে না বলে মনে করেন জিয়াউল হক।
তিনি বলেন, আমাদের দেশ থেকে বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সময় তারা শুধু দেখে যে শিক্ষার্থী টুয়েলভ গ্রেড পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে কিনা। এরপর শিক্ষার্থীর মেধা যাচাইয়ের প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব পদ্ধতিই অবলম্বন করে। আর সারা পৃথিবীতে অনেক জায়গাতেই করোনাভাইরাস মহামারির কারণে পাবলিক পরীক্ষা বা এক্সিট এক্সামগুলো নেওয়া সম্ভব হয়নি। কাজেই আমাদের শিক্ষার্থীদের ভিন্নভাবে যাচাই করা হবে বলে আমার মনে হয় না।
এদিকে জানুয়ারি মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রম শুরুর কথা বলা হলেও করোনার কারণে পরীক্ষা পেছাতে পারে। সেক্ষেত্রে শীতের শেষে ফেব্রুয়ারি বা মার্চে পরীক্ষাটি নেওয়া হতে পারে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি অপেক্ষা করতে না চায় তাহলে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে আয়োজন করা হলেও সশরীরে পরীক্ষাটি হবে না বলে সংশ্লিষ্টরা আভাস দিয়েছেন। ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর বলেছেন, আমরা গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করাব। এক্ষেত্রে তিনটি গুচ্ছ হবে। এগুলো হচ্ছে কৃষি, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি এবং সাধারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। প্রথম দুটির জন্য দুটি পরীক্ষা হবে। শেষেরটির জন্য বিজ্ঞান, কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান এবং বিজনেস স্টাডিজে তিনটি পরীক্ষা হবে। তিনি বলেন, আলোচনা অনুযায়ী বড় পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা পরীক্ষায় শিক্ষার্থী ভর্তি করবে। সূত্রমতে, দেশে বর্তমানে ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি করে থাকে। ইউজিসি কর্মকর্তারা জানান, প্রতি বছর গড়ে ৯ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে। তবে এ বছর সবাইকে পাস করিয়ে দেওয়ায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রথম বর্ষে ৬০ হাজারের মতো আসন আছে। এর বিপরীতে পরীক্ষা দেন ৫ থেকে ৬ লাখ শিক্ষার্থী। বাকিদের মধ্যে অনেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।