এক্সক্লুসিভ নিউজ : সারা দেশে চিনিকলের সংখ্যা ১৫। বেশি দামে উৎপাদন করে কম দামে বিক্রি করে বছরের পর বছর এসব প্রতিষ্ঠানের লোকসান গুনে আসার খবর সবারই জানা। চিনিকলগুলোর বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও পুরোনো। সে জন্য এসব প্রতিষ্ঠানে কী হচ্ছে, তা এবারে তৃতীয় চোখে দেখতে চায় শিল্প মন্ত্রণালয়।
চিনিকলগুলোতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাইরে রেখে কেবল মন্ত্রণালয়েরই ১৫ কর্মকর্তাকে নিয়ে সম্প্রতি একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। চিনিকলগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করা, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি ও অব্যাহত লোকসান কমানোর উদ্দেশ্যে এই কমিটি গঠন করা হয় বলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক অফিস আদেশে জানানো হয়েছে।
কমিটিতে চিনিকলগুলোর কোনো কর্মকর্তা–কর্মচারীকে না রাখা নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় বলছে, তারা অনেক সময় সঠিক তথ্য তুলে ধরে না। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনও (বিএসএফআইসি) লোকসানের সঠিক কারণ তুলে ধরছে না। তাই তাদের বাদ দিয়ে শুধু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁদের প্রত্যেককে সশরীর চিনিকলে গিয়ে যা-ই দেখবেন, তা–ই প্রতিবেদনে তুলে ধরতে হবে। প্রত্যেক সদস্যকে একটি করে চিনিকলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের এই কমিটি গঠন সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চিনিকলের লোকসান কমাতে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে কি না, সেটি দেখার বিষয়। তা ছাড়া চিনির দাম নির্ধারণ, শুল্ক, ভর্তুকি ও ঋণ বিতরণের মতো বিষয়গুলো সরকার ঠিক করে। সেখানে কমিটির সদস্যরা কী ভূমিকা রাখতে পারবে, তা নিয়েও সংশয় আছে। কমিটির সদস্যরা সরেজমিন পরিদর্শন শেষে যে প্রতিবেদন জমা দেবেন, তা কতটা প্রতিপালন করা হবে, সেটাও অনিশ্চিত।
উদাহরণ দিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কমিটির এক সদস্য একটি চিনিকল পরিদর্শনে গিয়ে দেখলেন ওই চিনিকলটির প্রতিযোগিতা সক্ষমতা নেই। তখন কী সিদ্ধান্ত আসবে?
শিল্প মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সরকারি চিনিকলে লোকসান বন্ধ করা যাবে না, এটা ঠিক। তবে লোকসান কমিয়ে আনা সম্ভব। এভাবে দিনের পর দিন লোকসান দিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। সে জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতি সদস্য প্রতি মাসে একবার তার দায়িত্বে থাকা চিনিকল পরিদর্শনে যাবেন। সেখান থেকে ফিরে এসে বিএসএফআইসির চেয়ারম্যানের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবেন।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান বলেন, ‘নতুন কমিটিকে ইতিবাচকভাবে দেখছি। কারণ, এরা কেউই চিনিকলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। সবাই বাইরের। চিনিকলে কী হচ্ছে, সেখানে কী করা উচিত, তাঁরা এসব প্রতিবেদনে তুলে ধরবেন।’
জানা গেছে, কমিটির সব সদস্যই উপসচিব পদমর্যাদার। তাঁদের মধ্যে এখন পর্যন্ত পাঁচজন কর্মকর্তা নিজ নিজ দায়িত্বে থাকা চিনিকল পরিদর্শনে গেছেন। তেমনই একজন নুরুল আমিন খান, যিনি পঞ্চগড় চিনিকলের দায়িত্ব পেয়েছেন। এরই মধ্যে তিনি একবার চিনিকলটি পরিদর্শন করে এসেছেন।
এই কমিটিতে নতুনত্ব কী এবং এই কমিটির কাছ থেকে কী আশা করা যায়, জানতে চাইলে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান বলেন, ‘নতুন কমিটিকে ইতিবাচকভাবে দেখছি। কারণ, এরা কেউই চিনিকলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। সবাই বাইরের। চিনিকলে কী হচ্ছে, সেখানে কী করা উচিত, তাঁরা এসব প্রতিবেদনে তুলে ধরবেন। কোন চিনিকলে কী ধরনের সমস্যা, শ্রমিকের সংখ্যা, মজুরি—এসব কিছুও দেখবেন। আশা করছি, ভালো কিছু ওঠে আসবে, যা সরকারের পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতিকৌশল প্রণয়নে কাজে আসবে।’
শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে চিনিকলগুলোর জন্য মোট ৩ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন। এর মধ্যে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরেই লোকসান ছিল ৯৭০ কোটি টাকা। তা ছাড়া চিনিকলগুলোর কারণে সব মিলিয়ে ৭ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা ব্যাংকঋণের দায় রয়েছে করপোরেশনের ঘাড়ে। শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও গ্র্যাচুইটি, ভবিষ্য তহবিল, আখের মূল্য ও সরবরাহকারীর বিল বাবদ বকেয়া পড়েছে ৫৫১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়ে চিনি উৎপাদন করেও বাজার কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না বিএসএফআইসি। প্রতিষ্ঠার সময় সরকারি চিনিকলগুলোর বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২ লাখ ১০ হাজার ৪৪০ মেট্রিক টন। তারা সর্বশেষ গত ২০১৯-২০ মাড়াই মৌসুমে মাত্র ৮২ হাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করেছে। দেশের বাজারে বছরে ১৮ লাখ মেট্রিক টন চিনির চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে করপোরেশন যে চিনি সরবরাহ করে, তা বাজার চাহিদার মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ।
কমিটি যা করবে : চিনিকলগুলোকে লাভজনক করে তুলতে কী কী করণীয়, সে সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা জমা দিতে হবে কমিটিকে। মিলগুলোর মালিকানাধীন স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির ওপর হালনাগাদ প্রতিবেদনও তৈরি করে দিতে হবে তাদের। তাতে জমির সব কাগজপত্র হালনাগাদ আছে কি না এবং কাগজপত্র অনুযায়ী জমি মিলের দখলে আছে কি না, তা উল্লখ করতে হবে প্রতিবেদন। ওভারহেডেড খাতের ব্যয় কোথায় হচ্ছে, তা পর্যালোচনা করে ব্যয় কমাতে কী করণীয়—সেই উপায় বের করতে হবে।
ফুড প্রসেসিং বা প্রক্রিয়াকরণের আওতায় কী ধরনের কার্যক্রম সংযুক্ত করা যেতে পারে এবং ওই কাজের জন্য কোনো ধরনের যন্ত্রপাতি পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে কি না, সে বিষয়ে মতামত দেবে কমিটি। প্রত্যেক কর্মকর্তা সরেজমিনে চিনিকল পরিদর্শন শেষে প্রতি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবেন।
দায়িত্ব পাওয়া ১৫ উপসচিব : শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিবদের মধ্যে জসীম উদ্দিনকে কেরু অ্যান্ড কোং, প্রতুল কুমার সাহাকে মোবারকগঞ্জ চিনিকল, মোখলেছুর রহমান আকন্দকে জিলবাংলা চিনিকল, সাইফুল ইসলামকে সেতাবগঞ্জ চিনিকল, ছরোয়ার হোসেনকে কুষ্টিয়া চিনিকল, শরিফ মো. মাসুদকে পাবনা চিনিকল, আমীর হোসেনকে ফরিদপুর চিনিকলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মিজানুর রহমান রংপুর চিনিকল, নিলুফার জেসমিন খান নর্থবেঙ্গল চিনিকল, মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান রাজশাহী চিনিকল, মোস্তাক আহমেদ নাটোর চিনিকল, কাজী ফারুক আহমদ জয়পুরহাট চিনিকল, নুরুল আমিন খান পঞ্চগড় চিনিকল, হারুন অর রশিদ ঠাকুরগাঁও চিনিকল এবং মনিরুজ্জামান শ্যামপুর চিনিকলের দায়িত্ব পেয়েছেন।
দায়িত্ব পাওয়া একাধিক কর্মকর্তা জানান, কোন প্রক্রিয়ায় গেলে চিনিকলগুলোকে লাভজনক করা যাবে, তাঁরা সেই উপায় বের করার চেষ্টা করবেন। চিনিকলগুলোকে কীভাবে গতিশীল করা যায়, তাঁরা সেই বিষয়ে পরামর্শ দেবেন। চিনিকল প্রতি মাসে একবার পরিদর্শন এবং সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও তদারকি করে কর্মপরিকল্পনা জমা দেবেন।