প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার অপেক্ষা স্বস্তি মিলছে না
ঢাকা: নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ প্রায় এক বছর আগে। এরপর থেকেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার জন্য অপেক্ষমাণ প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ চাকরিপ্রার্থী। কিন্তু কেউ বলতে পারছেন না এই পরীক্ষা কবে হবে। এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুন— এই পরীক্ষার জন্য আলোচনায় আছে এই পুরোটা সময়ই। বিভিন্ন গুঞ্জনের সূত্র ধরে পরীক্ষার্থীদের কেউ কেউ বলছেন, আসছে ডিসেম্বরে এই পরীক্ষা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, এ বছর কোনোভাবেই নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই!
অধিদফতর বলছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এলে এবং সব স্কুল-কলেজ খোলা থাকলে আগামী বছরের মার্চে এই পরীক্ষা হওয়ার কিছুটা সম্ভাবনা রয়েছে। আর মার্চে সম্ভব না হলে পরীক্ষা হবে আগামী বছরের মে বা জুন মাসে। মূলত মার্চ অথবা মে-জুন মাসকে পরীক্ষার সম্ভাব্য সময় ধরেই নিয়োগ কাজ এগিয়ে নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক পদে এর আগে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পর গড়ে ৪ থেকে ৮ মাসের মধ্যে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুধু ২০১৪ সালের নিয়োগ পরীক্ষাটি আদালত স্থগিত করলে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আর কোনো পরীক্ষা নিতেই নিয়োগ পরীক্ষার পর আট মাসের বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। এবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পর প্রায় এক বছর হয়ে গেলেও পরীক্ষার কোনো তারিখ নির্ধারণ করা যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বছরের মে-জুন মাসে এই নিয়োগ পরীক্ষা আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। তবে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ওই সময় মাত্রা ছাড়াতে থাকলে সবকিছু স্থবির হয়ে যায়। আটকে যায় এই নিয়োগ পরীক্ষাও। এরপর ধীরে ধীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে গেলে স্কুল-কলেজ পর্যন্ত খুলে দেওয়া হয়েছে। শুরু হয়েছে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষাও। তবু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে প্রাথমিকের এই নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। সারাদেশ যখন স্বাভাবিকতার পথে ফিরছে, সেই সময়েও এই পরীক্ষা আটকে থাকার বিষয়টি নিয়ে হতাশা জানাচ্ছেন আবেদনকারীরা।
চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন, প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের এই পরীক্ষা দেশের সবচেয়ে বড় নিয়োগ পরীক্ষা। গত বছর এই নিয়োগে চাকরিপ্রার্থী পরীক্ষার্থী ছিলেন প্রায় ২৪ লাখ। সেবার চারটি ধাপে নেওয়া হয় পরীক্ষা। মেয়েদের এই নিয়োগে আবেদনের যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক থেকে স্নাতকে উন্নীত করায় এ বছর অবশ্য চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা কমেছে। তারপরও সেই সংখ্যাটি সাড়ে ১৩ লাখ। এ বছরও দুই থেকে তিন ধাপে এই পরীক্ষা নিতে হতে পারে। অধিদফতর সূত্র বলছে, এই বিপুলসংখ্যক চাকরিপ্রার্থীর পরীক্ষার আয়োজনটি হবে বিশাল। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক না হলে সে প্রস্তুতি নেওয়া কঠিন হবে। এ কারণেই এই পরীক্ষা আয়োজনের কোনো তোড়জোড় নেই।
প্রাথমিকের এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আবেদনকারীর বলছেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পর এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে করতে তারা হতাশ হয়ে পড়ছেন। অনেকের সরকারি চাকরির বয়স শেষের পথে। পরীক্ষা না হওয়ায় তাদের হতাশা একটু বেশি। যারা আবেদন করেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলেন, মনোসংযোগ ধরে রাখতে পারছেন তারা তারাও। নারী চাকরিপ্রার্থীদের কারও কারও কারও বিয়েও হয়ে গেছে পরিবারের চাপে।
চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পর সময়ক্ষেপণ হলে নিয়োগ প্রক্রিয়াই প্রশ্নের মধ্যে পড়ে। ২০১৪ সালের স্থগিত হওয়া পরীক্ষা ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হলে যেমন পরীক্ষায় উপস্থিতির সংখ্যা ছিল প্রায় অর্ধেক। বেশিরভাগ ইউনিয়ন বা উপজেলায় অর্ধেকেরও কম পরীক্ষার্থী কেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন। এমনকি কোনো কক্ষে একজন পরীক্ষার্থীও পরীক্ষা দিয়েছেন! সেবার যারা পরীক্ষা দেননি তাদের অনেকেই জানিয়েছেন, তারা পরীক্ষার প্রবেশপত্রসহ সংশ্লিষ্ট সব তথ্য চার বছর ধরে সংরক্ষণ করতে পারেননি। এবারেও আরও সময় নেওয়া হলে অনেকেরই এমন পরিস্থিতি হবে পারে বলে মনে করছেন আবেদনকারীরা।
কেন নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না— এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রণালয়ে নতুন সচিব এসেছেন। অধিদফতরের ‘পেছনের কর্মকাণ্ড’ নিয়ে তাকে বেশি ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে এখনো কোনো চিন্তা করছেন না। অন্যদিকে অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তারা এখনো নিয়োগ কমিটিকে সবকিছু বুঝিয়ে দেননি। তাই সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এ বছরে হওয়ার সম্ভাবনা দেখছি না।
আগামী বছর কোন সময়ে পরীক্ষা হতে পারে— এ বিষয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, মার্চ মাসে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে শীর্ষ পর্যায়ে খসড়া কথাবার্তা হলেও তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কি না তা বলা মুশকিল। আবার এপ্রিল মাসে রোজা ও ঈদ থাকায় ওই মাসে পরীক্ষা নেওয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার মাঝামাঝি সময়টাকে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার জন্য বেছে নেওয়া হতে পারে। মে ও জুন মাসে দুই বা তিন ধাপে এই পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে দীর্ঘ দেড় বছর পর খুলেছে স্কুল-কলেজ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জানুয়ারিতেও স্কুল খোলা থাকলে সারাদেশে শিক্ষক সংকটে পড়বে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। কেননা গত বছরের অক্টোবরে যখন এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় তখনই প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষকের ঘাটতি ছিল। গত এক বছরে আরও অন্তত ১০ হাজার শিক্ষক অবসর নিয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রাথমিকে সহকারী শিক্ষকের ঘটাত দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ হাজারে। এই বিশাল ঘাটতি রেখে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে পাঠদান করানো সম্ভব হবে না। ফলে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করা না গেলে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সংকটের মুখে পড়বে।
সার্বিক বিষয়গুলো নিয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) আলমগীর মো. মনসুর আলম বলেন, এ বছর নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে— এরকম কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। আগামী বছরের শুরুতে না হলেও মাঝামাঝি সময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে পারে। নিয়োগ পরীক্ষার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হবে। সেই বৈঠকের তারিখও এখনো নির্ধারণ হয়নি। ওই বৈঠকের পর বলা যাবে— কবে নাগাদ পরীক্ষা নেওয়া হতে পারে।