এক্সক্লুসিভ নিউজজাতীয়জীবনযাত্রাদৃষ্টি আকর্ষণরাজনীতিলিড নিউজ

যে চিকিৎসা প্রয়োজন খালেদা জিয়ার

যে চিকিৎসা প্রয়োজন খালেদা জিয়ার

ঢাকা: আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দীর্ঘ দিন ধরেই আক্রান্ত। তবে গত কয়েক মাসে তাকে চিকিৎসার জন্য বারবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, খালেদা জিয়ার অবস্থা অত্যন্ত ‘ক্রিটিক্যাল’। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির কয়েকটি অ্যাডভান্সড সেন্টারেই কেবল তার চিকিৎসা সম্ভব।

কিন্তু খালেদা জিয়া বর্তমানে প্রকৃতপক্ষে কোন রোগে আক্রান্ত, সেটিই স্পষ্ট করে বলছিলেন না বিএনপি নেতারা। তার চিকিৎসক দলের পক্ষ থেকে এবারে জানানো হলো— তিনি প্রকৃতপক্ষে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। এটি এখন অনেকটাই বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এই রোগের যে পর্যায়ে খালেদা জিয়া আছেন, তার চিকিৎসক দলও জানাচ্ছে যে এর চিকিৎসা দেশে সম্ভব নয়।

রোববার (২৮ নভেম্বর) সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসায় তার চিকিৎসক দলের অন্যতম সদস্য ডা. এফ এম সিদ্দিকী এক ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন। তিনি জানান, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে ‘প্রকৃত’ তথ্য তুলে ধরতে এই ব্রিফিং তারা আয়োজন করেছেন।

সবশেষ হাসপাতালে খালেদা জিয়ার ভর্তি হওয়ার কারণ এবং ভর্তির পরের চিকিৎসার বিভিন্ন তথ্য ব্রিফিংয়ে তুলে ধরেন ডা. সিদ্দিকী। তিনি জানান, হঠাৎ করে খালেদা জিয়া প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে তার রক্ত পরীক্ষা করা হয়। দেখা যায়, তার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা অনেক কমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে তাকে দুই ব্যাগ পিআরবিসি (প্যাকড রেড ব্লাড সেল, কনসেন্ট্রেটেড আরবিসি) দেওয়া হয়। এরপর তার রক্তক্ষরণের উৎস খুঁজে বের করতে এন্ডোস্কোপি করা হয়। তবে তাতে রক্তক্ষরণের উৎস জানা সম্ভব হয়নি।

ডা. সিদ্দিকী বলেন, প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা দিয়ে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল করে তোলা হয়। তার রক্তক্ষরণও বন্ধ হয়। তবে দুই-তিন পর ফের রক্তক্ষরণ শুরু হয় তার। ঝুঁকি নিয়েও তার একাধিকবার এন্ডোস্কোপি করা হয়। তবে দুই বার এন্ডোস্কোপি করেও তার রক্তক্ষরণের উৎস জানা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যেই কেবল শরীরে অভ্যন্তরেই কেবল নয়, বাহ্যিকভাবেও রক্তক্ষরণ হতে থাকে খালেদা জিয়ার। এমনকি শেষের দিকে তার মলের সঙ্গেও তাজা রক্ত আসতে থাকে। এ অবস্থায় তাকে দ্রুত অব্যাহতভাবে ফ্লুইড (তরল) দেওয়া হতে থাকে এবং ‘লাইফ সেভিং’ কিছু ওষুধের মাধ্যমে তাকে স্থিতিশীল করে তোলা হয়। কিন্তু তার রক্তক্ষরণের উৎস তখনো তারা জানতে পারেননি।

ডা. এ এফ এম সিদ্দিকী বলেন, ২৪ তারিখে আবার তাকে ওই অবস্থায় জেনারেল ওটিতে নেওয়া হয়। অন্য কোনো কমপ্লিকেশন থাকলে যেন দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সে কারণেই তাকে জেনারেল ওটিতে নেওয়া হয়। ব্লাড ট্রান্সফিউশন করে আবার এন্ডোস্কোপি করানো হয়। এবার দেখা গেল, আরেকটু নিচের জায়গা থেকে ম্যাসিভ ব্লিডিং হচ্ছে। এন্ডোস্কোপিতে সাধারণত পাকস্থলি এলাকা দেখা হলেও ডা. আরেফিন ডিওডেনাম (ক্ষুদ্রান্ত্র) পর্যন্ত দেখেছেন। কিন্তু রক্তক্ষরণের উৎস শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এরপর বাধ্য হয়ে তার কোলোনস্কপি করা হলো। আমরা নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না— তার পুরোটা কোলনে রক্ত জমাট বেঁধে ছিল। সেই রক্ত পরিষ্কার করে কোলনের একদম শেষ প্রান্ত পর্যন্ত গিয়েও তার রক্তক্ষরণের উৎস বের করা সম্ভব হয়নি।

যে চিকিৎসা প্রয়োজন খালেদা জিয়ার : রক্তক্ষরণের উৎস জানা সম্ভব হলে সে অনুযায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব হতো বলে জানান ডা. সিদ্দিকী। কিন্তু সেটি করতে সক্ষম না হওয়া আপাতত বিভিন্ন ধরনের ‘লাইফ সেভিং মেডিসিন’ দিচ্ছেন তারা, রক্ত সঞ্চালনও করা হচ্ছে খালেদা জিয়ার শরীরে। আর এখন একটাই চিকিৎসা তারা দেখতে পারছেন, ব্রিফিংয়ে তুলে ধরেন সেটির কথাও।

ডা. সিদ্দিকী বলেন, লিভার সিরোসিস যখন এমন একটি অবস্থায় পৌঁছে যায় তখন চিকিৎসার একটাই রাস্তা থাকে— এটিকে বলে টিপস (TIPS, ট্রান্সজাগলার ইন্ট্রাহেপাটিক পোর্টোসিস্টেমিক শান্ট)। হৃদযন্ত্রে ব্লক থাকলে স্টেন্টিংয়ের মাধ্যমে যেমন বাইপাস করা হয়, এই পদ্ধতিও অনেকটা তেমনই। তবে এটি একেবারেই অপ্রচলিত এবং এটি করার জন্য অসম্ভব দক্ষ চিকিৎসকের প্রয়োজন। এই স্টেন্টিং এমন একটি হাতের কাজ, যার মাধ্যমে ভেইন দিয়ে স্টেন্ট লিভারে পৌঁছে দিয়ে বাইপাস করা হয়ে থাকে।

ডা. সিদ্দিকী বলেন, এটি অত্যন্ত দক্ষ টেকনিক। ভারতীয় উপমহাদেশ তো বটেই, সিংগাপুর-ব্যাংককেও এই টেকনিক নিয়ে কাজ করা হয় না। এটি নিয়ে সচরাচর (ফ্রিকোয়েন্টলি) কেউ কাজ করেন না। অ্যাডভান্সড কিছু রেফারেল সেন্টার আছে, সেখানকার হাতেগোনা দুয়েকজন চিকিৎসকই কেবল এই কাজটি করে থাকেন।

খালেদা জিয়ার এই চিকিৎসক আরও বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় খালেদা জিয়ার রক্তক্ষরণ হয়নি। তিনি অনেকটাই স্থিতিশীল আছেন। কিন্তু এ ধরনের রোগীকে যথাযথ চিকিৎসা তথা TIPS অ্যাপ্লাই করা না হলে আগামীতেও তার রক্তক্ষরণের আশঙ্কা রয়েছে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তার ফের রক্তক্ষরণ হতে পারে। এটি অনেকটাই অবশ্যম্ভাবী। অ্যাডভান্সড সেন্টার যেগুলো আছে, সেখানে এ ধরনের রোগীদের ডাটা আছে। এ ধরনের রোগীদের শারীরিক কোনো সমস্যা হলে কীভাবে তাদের জীবন বাঁচানোর উপযোগী চিকিৎসা দেওয়া যায়, সেটি তারা জানে। বর্তমান অবস্থায় আমরা হেল্পলেস (অসহায়) বোধ করছি।

ডা. সিদ্দিকী আরও বলেন, খালেদা জিয়া আমাদের ওপর যথেষ্ট আস্থা রাখেন। আমরাও যথাসাধ্য তার চিকিৎসা করছি। তিনি বারবারই সিরিয়াস অবস্থায় চলে যাচ্ছিলেন। তারপরও আমরা যথেষ্ট কনফিডেন্ট ছিলাম। কিন্তু এবারে আমরা অসহায় বোধ করছি। খালেদা জিয়া নিজেও আমাদের চেহারা দেখে অধ্যাপক জাহিদকে (ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন) জিজ্ঞাসা করেছেন, আমাদের মুখ কালো কেন? পরে আমরা আবার তার সঙ্গে দেখা করেছি। আমরা যথাসাধ্য তাকে আশ্বস্ত করেছি। কিন্তু আমরা নিজেরাই বুঝতে পারছি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদেরও তো কিছু করার উপায় থাকে না।

ডা. এ এফ এম সিদ্দিকী বলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে নানা ধরনের তথ্য অনেকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় আমরা মনে করেছি, তার শারীরিক অবস্থার সঠিক তথ্যটি সবার কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। আপনারা (গণমাধ্যমকর্মী) সবসময়ই দেশ ও জাতির কাছে সঠিক তথ্যটিই জানিয়ে এসেছেন। তাই আপনাদের মাধ্যমেই সবার কাছে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার সবশেষ ও সঠিক তথ্যটি তুলে ধরার প্রয়োজন মনে করেছি বলেই আপনাদের সামনে এসেছি।

এমন আরও সংবাদ

Back to top button