দেশজুড়ে

ঔষধি গাছে বদলে গেলো ১৫ গ্রামের ভাগ্য

দেশের একমাত্র ভেষজ ‘ঔষধি গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত নাটোর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়ন। ১৫টি গ্রাম নিয়ে গঠিত এই ইউনিয়নে প্রায় ২২ হাজার মানুষের বসবাস। একসময় এখানের মানুষ কৃষিকাজ করতেন। গত ২৬ বছরে বদলে গেছে এলাকার চিত্র। এখন ভেষজ উদ্ভিদ লাগিয়ে বছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকা আয় করছেন তারা।

স্থানীয় সূত্র জানায়, ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম এখন উন্নত। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও মানুষের জীবনযাত্রা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। প্রত্যেক গ্রামের জমি ও বাড়িঘরের আনাচে-কানাচে লাগানো হয়েছে ঔষধি গাছ। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভেষজ সামগ্রী বিক্রির দোকান। প্রতিদিন ভিড় করেন পাইকারি ও খুচরা ক্রেতা-বিক্রেতারা। ট্রাকে ট্রাকে প্রতিদিন কিনে নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ঔষধি গাছ। শুরুতে মানুষ নিজের জমিতে শ্রমিকের কাজ করতেন। এখন তারা বাজারজাত করছেন। চাষাবাদের জন্য রেখেছেন শ্রমিক। তাদের জমিতে প্রতিদিন কাজ করতে আশপাশের এলাকা থেকে আসছেন চার শতাধিক শ্রমিক।

স্থানীয় কৃষকরা জানিয়েছেন, ১৯৯৫ সালে খোলাবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা বৃক্ষপ্রেমিক আফাজ উদ্দিন পাগলা ভেষজ উদ্ভিদ দিয়ে কবিরাজি চিকিৎসা করতেন। সুনাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসার চাহিদা বেড়ে যায়। দূর-দূরান্ত থেকে ভেষজ উদ্ভিদ নিয়ে আসার ঝামেলা এড়াতে বাড়ির আশপাশে চাষাবাদ শুরু করেন বিভিন্ন ভেষজ গাছ। একসময় চিকিৎসার প্রয়োজন মিটিয়ে তিনি অতিরিক্ত ঔষধি গাছ, লতা ও শেকড় বিক্রি করে বাড়তি আয় করতে থাকেন।

তাকে দেখে উৎসাহ পান স্থানীয় কৃষকরা। শুরু করেন ভেষজ গাছ উৎপাদন আর বাজারজাতকরণ। ধান ও শাকসবজির তুলনায় অধিক মুনাফা হওয়ায় ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ভেষজ গাছ উৎপাদনকারী কৃষকের সংখ্যা। বর্তমানে লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নের খোলাবাড়িয়া, কাঁঠালবাড়িয়া, গাজীপুর, চৌরী ও ইব্রাহিমপুরসহ ১৫ গ্রামে বিভিন্ন ধরনের ঔষধি গাছ চাষাবাদ হয়।

natore3ভেষজ উদ্ভিদ লাগিয়ে বছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকা আয়

সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১৫টি গ্রামে ১৪০ প্রজাতির ঔষধি গাছ চাষাবাদ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অ্যালোভেরা, শিমুল মূল, অশ্বগন্ধা, মিশ্রিদানা, শতমূল, কালোমেঘ, হস্তিপলাশ, আমলকি, হরিতকি, বহেড়া, ওলট কম্বল, অর্জুন, বেল, ভুঁইকুমড়া, আলকুশি, পিপুলটি, দাউদমণি, সোনাপাতা, ডাল মূল, কস্তুরিদানা, শিলাজিৎ, তেঁতুল ও ভাইচন্ডাল, পাথর কুচি, রক্তচন্ডাল, লজ্জাবতী, আকন্দ, স্বর্ণগন্ধা, শঙ্খমূল, ঈশ্বরমূল, তেজবল, আপাং ও অনন্তমূল।

কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, রাস্তার উভয় পাশে, কৃষি জমিতে, বাড়ির আনাচে-কানাচে শোভা পাচ্ছে অ্যালোভেরা, শতমূল, লজ্জাবতী ও নিমসহ নানা ধরনের গাছ। সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ও বেশি চাষাবাদ হচ্ছে অ্যালোভেরা।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, প্রতি বছর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত রোপণ করা হয় অ্যালোভেরা। এক বিঘা জমিতে প্রায় ১২ হাজার চারা রোপণ করা হয়। তিন মাস পর থেকেই শুরু হয় ডাল সংগ্রহ। চাষাবাদ, পরিচর্যা আর সেচ দিতে বিঘাপ্রতি বছরে প্রায় ১০০ শ্রমিক লাগে। অ্যালোভেরা চাষে জৈব সার ছাড়াও পরিমাণমতো ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, দস্তা ও বোরিক অ্যাসিড দেওয়া হয়। এ ছাড়া পাতার কালো দাগ দূর করতে দেওয়া হয় চুন। কীটনাশক হিসেবে ট্রাইকোডার্মা ও সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করা হয়।

খোলাবাড়িয়া গ্রামের কৃষক আবুল হোসেন বলেন, এক বিঘা জমিতে শিমুল চাষ করতে খরচ হয় ১৫-১৬ হাজার টাকা। উৎপাদিত গাছ বিক্রি হয় এক থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত। এক বিঘা জমিতে অ্যালোভেরা চাষ করতে খরচ হয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা। উৎপাদিত পাতা বিক্রি হয় দেড় লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা। খরচ বাদে বিঘাপ্রতি প্রায় ৮০-৯০ হাজার টাকা আয় হয়।

খোলাবাড়িয়া বাজারের কবিরাজ মো. শামসুজ্জামান মিয়া বলেন, অ্যালোভেরা কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয়। ব্লাড প্রেসারকে নিয়ন্ত্রণ করে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখে এবং রক্তে অক্সিজেন বহন করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। দূষিত রক্ত দেহ থেকে বের করে রক্ত কণিকা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে অ্যালোভেরা। শিমুল পাতা, মূল ও আঠা বলকারক ও ফুল শ্বেত প্রদাহে ব্যবহার হয়। মিশ্রিদানা গ্যাস্ট্রিক আমাশয় নিবারণ করে। বাসক পাতার রসে সর্দি-কাশি ও জ্বর ভালো হয়। গন্ধভাদালি লতা পেটের পীড়ায় কাজ করে, তুলসি পাতা জ্বর ও সর্দি সারাতে কাজ করে। পিপুল পাতা প্রস্রাবের জ্বালা কমায়, ছাল দিয়ে হালুয়া তৈরি হয়। পাথরকুচি আমাশয় ও বদ হজমে কাজ করে। ডুমুর ফল ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, তেঁতুল রক্তের কোলেস্টেরল কমায়, অর্জুনপাতা ও ছাল হার্টের রোগ সারায়। এ ছাড়া নিমপাতা, ছাল ও বীজ কৃমিনাশক।

ঔষধি গ্রাম সম্পর্কে জানতে চাইলে নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মাহমুদুল ফারুক বলেন, ঔষধি গ্রামে গাছ উৎপাদনকারী রয়েছেন ৯৫০ জন। বীজ সরবরাহকারী ১৫ জন, চারা উৎপাদক ও সরবরাহকারী নয় জন, ঔষধি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকারী ১২ জন, মজুতকারী ৩২ জন, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতা ২২ জন, হকার এবং ফড়িয়া ২৫০ জন। কবিরাজ রয়েছেন ১৭ জন।

natore1বেশি চাষাবাদ হচ্ছে অ্যালোভেরা

মাহমুদুল ফারুক বলেন, প্রতিবিঘা জমিতে অ্যালোভেরা চাষ শেষে উৎপাদিত অংশ বছরে বিক্রি হয় প্রায় এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। এক লাখ টাকার শিমুল, ৫৬ হাজার টাকার মিশ্রিদানা ও অশ্বগন্ধা ৬৪ হাজার টাকার বিক্রি হয়।

২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী, অ্যালোভেরা চাষ হয়েছে ৬৫ হেক্টর জমিতে। উৎপাদিত হয়েছে ১৩ হাজার ১৩০ মেট্রিক টন। যার বাজারমূল্য আট কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ৫৩ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে শিমুল মূল। উৎপাদন হয়েছে এক হাজার ২৭২ মেট্রিক টন। যার বাজারমূল্য তিন কোটি ৯৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ১০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে অশ্বগন্ধা। উৎপাদন হয়েছে ১৮ মেট্রিক টন। যার বাজারমূল্য ৪৮ লাখ টাকা। ৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে মিশ্রিদানা। উৎপাদন হয়েছে ৫০ মেট্রিক টন। যার বাজারমূল্য ২১ লাখ টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য ভেষজ উদ্ভিদ চাষাবাদ হয়েছে সাত হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয়েছে ১৪০ মেট্রিক টন। যার বাজারমূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বছরে আয় হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। ভেষজ উদ্ভিদ চাষাবাদ খরচ বাদ দিলে যে মুনাফা হয় তা যেকোনও ফসলের তুলনায় ৮-১০ গুণ বেশি।

কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, এলাকার চার স্থানে গড়ে উঠেছে প্রায় ৩০টি ভেষজ সামগ্রী বিক্রির দোকান। দোকানগুলোতে অ্যালোভেরা চারা ছাড়াও বিভিন্ন পাতা, মূল, বীজ, ছাল ও গুঁড়া ভেষজ বিক্রি করছেন দোকানিরা।

লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া মোড়ের বনলতা ভেষজের দোকানি কাজী কবির আহমেদ বলেন, আমাদের কাছ থেকে হামদর্দ ছাড়াও আরও কয়েকটি কোম্পানি অ্যালোভেরাসহ বিভিন্ন ভেষজ গাছ কিনে নেন। সবচেয়ে বেশি অ্যালোভেরা কিনে ময়মনসিংহের ভালুকার বিদেশি প্রতিষ্ঠান তাইওয়ান সিন লিন এন্টারপ্রাইজ। পাশাপাশি প্রতিদিন ট্রাকে করে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে অ্যালোভেরাসহ বিভিন্ন ভেষজ সামগ্রী যায়। পাইকারি ও ফড়িয়া এবং খুচরায় ভেষজ বিক্রি হয়। প্রতিদিন পাঁচ হাজার থেকে লক্ষাধিক টাকার সামগ্রী বিক্রি হয় প্রতি দোকানে।

খোলাবাড়িয়া গ্রামের ব্যবসায়ী জয়নুল আবেদীন বলেন, প্রতিদিন সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় অ্যালোভেরা। এর প্রধান কারণ অ্যালোভেরা পাতা সরবত থেকে শুরু করে প্রসাধনীতে ব্যবহার করা হয়। এজন্য এলাকার প্রায় সব কৃষক অন্যান্য ভেষজের সঙ্গে অ্যালোভেরা চাষ করেন।

স্থানীয় কৃষক ও ব্যবসায়ী আফজাল বলেন, বর্তমানে প্রতিকেজি অ্যালোভেরা ১৫ টাকা বিক্রি করছি। স্থানীয়ভাবে অ্যালোভেরা সংরক্ষণের সুযোগ নেই। সংরক্ষের সুযোগ থাকলে অ্যালোভেরা ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠতো। দ্বিগুণ দামে বিক্রি করে আমরা লাভবান হতাম। তবে সংরক্ষণের অভাবে ভেষজ সামগ্রী কম দামে বিক্রি করতে হয়, না হয় ফেলে দিতে হয়।

এমন আরও সংবাদ

Back to top button