ইসলাম

কুরআন ও হাদিসে ভালো কাজ

সমস্ত প্রমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য, যিনি সমগ্র বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন। দরুদ ও সালাম মানবতার মুক্তিদূত মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি, যার আগমন পৃথিবীর বুক থেকে যাবতীয় অন্ধকার-অনাচার বিতাড়িত হয়ে মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল।

প্রিয় পাঠক, সাপ্তাহের ধারাবাহিক আলোচনায় প্রতি শুক্রবার প্রতিদিনের সংবাদ আমাদের জন্য ইসলামের আলোকে সামাজিক সমস্যা ও এর সমাধান নিয়ে কুরআন-হাদিসের আলোচনা উপস্থাপন করে। সে অনুযায়ী আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু ভালো কাজ।

ধরুন, আপনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। এ সময় দেখলেন, ফেরি করে তরকারি বিক্রি করছেন এক ব্যক্তি। ক্রেতাকে সবজি দেওয়ার পর তিনি তার বোঝাটা মাথায় তুলতে পারছেন না। আপনি কাছে গিয়ে তার সেই বোঝা মাথায় তুলে দিলেন। এটা ভালো কাজ।

রাস্তায় একটি ম্যানহোল দেখলেন, যা লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকায় যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, সেখানে আপনি একটি চিহ্ন দিয়ে লোকজনকে দুর্ঘটনার কবল থেকে বাঁচাতে পারেন। কিংবা পথের মধ্যে মানুষের জন্য কষ্টদায়ক কোনো বস্তু পড়ে থাকতে দেখলে তা অপসারণ করে কষ্ট দূর করতে পারেন এগুলোও ভালো কাজ।

আবার নামায আদায়, রোজা রাখা, জাকাত দান, হজ করা এগুলোও ভালো কাজের অন্তর্ভুক্ত।

কুরআন-হাদিসের আলোকে ভালো কাজ : আলোচনার প্রথমে আমরা জেনে নেবো ভালো কাজের মানদণ্ড কেমন। পৃথিবীতে দুই ধরনের ভালো কাজ আছে। যেমন-

১. নৈতিক ভাল কাজ : আমি প্রতিবেশীর প্রতি ভালো। কর্মক্ষেত্রে সৎ। আমি মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করি। চুরি করি না। আমি মানুষকে ঠকাই না। এগুলোকে নৈতিক ভালো কাজ বলে।

২. ধর্মীয় ভাল কাজ : আমি হজ্জে যাই। যাকাত দেই। আমি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি। রমজান মাসে রোজা পালন করি। এগুলো নৈতিক অর্থে ভালো কাজ না হলেও ধর্মীয় অর্থে ভালো কাজ।

মুসলিম বিশ্বে আপনি এমন মানুষ খুঁজে পাবেন, যারা নৈতিকভাবে ভালো। তারা তাদের পরিবারের সঙ্গে ভালো। সন্তানদের যত্ন নেন। তারা বাড়িতে বেশ দায়িত্বশীল। প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভালো। কর্মক্ষেত্রে তারা সৎ, ভালো মানুষ, কিন্তু তাদের মধ্যে ধর্ম বলতে কিছু নেই। “ভাল হওয়ার জন্য আমার ধর্ম লাগে না”- এটাই তাদের কথা।

অন্যদিকে এমন মানুষও আছেন, যারা নামাজ আদায় করেন, হজে যান, যাকাত দেন, লম্বা দাড়ি রাখেন, ধার্মিক পোশাক পরেন, কিন্তু তারপরও তারা তাদের পরিবারের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। ব্যবসায় মানুষকে ধোঁকা দেন। অত্যন্ত অনৈতিক মানুষ।

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে এই দুটিকে একত্রিত করেছেন, যাকে বলা হয় ‘আয়াতুল বির’ তথা সদগুণের আয়াত। আপনি এই আয়াত নিয়ে গবেষণা করলে দেখবেন, এখানে রয়েছে দুটি জিনিসের সমাহার, নৈতিক নীতি ও ধর্মীয় নীতির একটি সমন্বয়; যেমন কথা রাখা, সত্য বলা, কাউকে না ঠকানো, ধৈর্যশীল হওয়া ইত্যাদি নৈতিক নীতি। নামাজ কায়েম করা, যাকাত দেওয়া এগুলো ধর্মীয় নীতি। আলোচ্য আয়াত একই সঙ্গে দুটো জিনিসের সমন্বয়।

কুরআন-হাদীসে অনেক এমন ভালো কাজের কথা বলা আছে যা করা সামান্য সময়ের ব্যাপার বা খুবই কম কষ্টে সেগুলো করা যায়, কিন্তু সেগুলোর ফযীলত অনেক বেশি। কোনো কোনো আমল আছে, যা জীবনের সমস্ত গুনাহ মুছে দেয় যদিও তা সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হয় আবার কোনো আমল রয়েছে গুনাহগার ব্যক্তিকে এমনভাবে নিষ্পাপ করে দেয়, যেভাবে সে যেদিন মায়ের পেট থেকে জন্মলাভ করেছে আবার এমন কিছু আমলও আছে, যা গুনাহগারের জীবনের পূর্বের ও পরের সমস্ত গুনাহ মুছে দেয়। এসব আমল যদি মানুষ জানত তাহলে তারা অবশ্যই তা করত।

কুরআন ও হাদীসে এমন অনেক ভালো কাজের কথা বর্ণিত হয়েছে যে কাজগুলো করলে আল্লাহ তাআলা মুমিন-মুত্তাক্বীদের পাপসমূহ দূর করবেন এবং তাদের গুনাহগুলো মাফ করে দেবেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, “ভালো কাজ এটা নয় যে, তোমরা তোমাদের চেহারা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ফিরাবে; বরং ভালো কাজ হলো যে ঈমান আনে আল্লাহ, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি এবং যে সম্পদ প্রদান করে তার প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও নিকটাত্মীয়গণকে, ইয়াতীম, অসহায়, মুসাফির ও প্রার্থনাকারীকে এবং বন্দিমুক্তিতে এবং যে সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং যারা অঙ্গীকার করে তা পূর্ণ করে, যারা ধৈর্যধারণ করে কষ্ট ও দুর্দশায় ও যুদ্ধের সময়ে। তারাই সত্যবাদী এবং তারাই মুত্তাকী।” (সূরা বাকারা : ১৭৭)

কাতাদাহ ও আবুল আলীয়াহ বলেন, ইহুদিরা ইবাদতের সময় পশ্চিম দিকে আর নাসারারা পূর্ব দিকে মুখ করে থাকে। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

আল্লাহ্ তাআলা তাদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনায় বলেন, সালাতে পূর্বদিকে মুখ করে দাঁড়াতে হবে কি পশ্চিমদিকে, এ বিষয় নির্ধারণকেই যেন তোমরা দ্বীনের একমাত্র লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছ এবং এ ব্যাপারটিকে কেন্দ্র করেই তোমাদের যাবতীয় আলোচনা-সমালোচনা আবর্তিত হতে শুরু করেছে। মনে হয়, তোমাদের ধারণায় শরীআতের অন্য কোন হুকুম-আহকামই যেন আর নেই।

তাফসীরে বাগভীতে এই আয়াতের দুটি অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে- ১. আল্লাহর ভালোবাসায় উপরোক্ত খাতে সম্পদ ব্যয় করা। ২. সম্পদের প্রতি নিজের অতিশয় আসক্তি ও ভালোবাসা থাকা সত্বেও উপরোক্ত খাতসমূহে সম্পদ ব্যয় করা। উভয় অর্থই এখানে উদ্দেশ্য হতে পারে। তবে শেষোক্ত মতটিকেই অধিকাংশ আলেম প্রাধান্য দিয়েছেন।

এ মতের সপক্ষে বিভিন্ন হাদীসে সম্পদের আসক্তি সত্বেও তা ব্যয় করার ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে। এক হাদীসে এসেছে, এক লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে জিজ্ঞাসা করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সব চেয়ে বেশি সওয়াবের সাদাকাহ কোনটি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তুমি সুস্থ ও আসক্তিপূর্ণ অবস্থায়, দরিদ্র হয়ে যাওয়ার ভয়, ধনী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও দান করা”। (বুখারী: ১৪১৯, মুসলিম: ১০৩২)

এ আয়াতের বর্ণনাভঙ্গির দ্বারা এ তথ্যও সাব্যস্ত হয়ে যায় যে, ধন-সম্পদের ফরয শুধুমাত্র যাকাত প্রদানের মাধ্যমেই পূর্ণ হয় না, যাকাত ছাড়া আরও বহু ক্ষেত্রে সম্পদ ব্যয় করা ফরয ও ওয়াজিব হয়ে থাকে। যেমন, আয়-উপার্জনে অক্ষম আত্মীয়-স্বজনের ব্যয়ভার বহন করা ওয়াজিব হয়ে যায়। কারো সামনে যদি কোনো দরিদ্র ব্যক্তির জীবন বিপন্ন হয়, তবে যাকাত প্রদান করার পরেও সে দরিদ্রের জীবন রক্ষার্থে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করা ফরয হয়ে পড়ে। অনুরূপ যেসব স্থানে প্রয়োজন রয়েছে, সেখানে মসজিদ তৈরি করা এবং দ্বীনী শিক্ষার জন্য মক্তব-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করাও আর্থিক ফরজের অন্তর্গত। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, যাকাতের একটা বিশেষ বিধান রয়েছে, সে বিধান অনুযায়ী যেকোনো অবস্থায় যাকাত প্রদান করতে হবে, কিন্তু অন্যান্য খরচের ফরজ হওয়ার বেলায় প্রয়োজন দেখা দেয়া শর্ত। (তাফসিরে মাআরিফুল কুরআন)

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “সবচেয়ে উত্তম সদকাহ হচ্ছে সেটি, যা এমন আত্মীয়-স্বজনের জন্য করা হয়, যারা তোমার থেকে বিমুখ হয়ে আছে।” (মুসনাদে আহমাদ:৩/৪০২, সহীহ ইবনে খুযাইমাহ: ৪/৭৮)

অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মিসকীনের উপর সদকাহ করলে সেটি সদকাহ হিসেবে বিবেচিত হবে। পক্ষান্তরে যদি আত্মীয়-স্বজনের উপর সদকাহ করা হয় তবে তা হবে, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও সদকাহ।” (মুসনাদে আহমাদ: ৪/১৮)

অর্থাৎ মুমিন ব্যক্তির মধ্যে ওয়াদা-অঙ্গীকার পূর্ণ করার অভ্যাস সব সময়ের জন্য থাকতে হবে, ঘটনাচক্রে কখনো কখনো অঙ্গীকার পূরণ করলে চলবে না। কেননা, এরূপ মাঝে-মধ্যে কাফের-গোনাহগাররাও ওয়াদা-অঙ্গীকার পূরণ করে থাকে। সুতরাং এটা ধর্তব্যের মধ্যে আসবে না। তেমনিভাবে মুআমালাতের বর্ণনায় শুধুমাত্র অঙ্গীকার পূরণ করার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। একটু চিন্তা করলেই দেখা যায় যে, ক্রয়-বিক্রয়, অংশীদারিত্ব, ভাড়া-ইজারা প্রভৃতি বৈষয়িক দিকসমূহের সুষ্ঠতা ও পবিত্রতাই অঙ্গীকার পূরণের উপর নির্ভরশীল।

আখলাক বা মন-মানসিকতার সুস্থতা বিধান সম্পর্কিত বিধি-বিধানের আলোচনায় একমাত্র ‘সবর’-এর উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা, ‘সবর’-এর অর্থ হচ্ছে মন-মানসিকতা তথা নফসকে বশীভূত করে অন্যায়-অনাচার থেকে সর্বোতভাবে সুরক্ষিত রাখা। একটু চিন্তা করলেই বুঝা যাবে যে, মানুষের হৃদয়বৃত্তিসহ অভ্যন্তরীণ যত আমল রয়েছে, সবরই সেসবের প্রাণস্বরূপ। এরই মাধ্যমে সর্বপ্রকার অন্যায় ও কদাচার থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ হয়।

সুতরাং দেখা যায়, ইসলাম মানুষের সেবা ও খিদমতের জন্য, সমাজের উপকারের জন্য নিজের যথাসর্বস্ব বিলিয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করে। যাতে সমাজ থেকে অশান্তি ও অবজ্ঞা দূর হয়ে নেমে আসে সমাজজীবনে শান্তির ফল্গুধারা। ইসলাম শুধু মানুষের সেবার প্রতিই উদ্বুদ্ধ করে না। আল্লাহর সব সৃষ্টির প্রতি সেবাদানের ব্যাপারেও অনুপ্রাণিত করে। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে বেশি বেশি ভালো কাজ করার তৌফিক দিন। আমিন।

এমন আরও সংবাদ

Back to top button