উত্তরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি রাঙ্গামাটিতে ২৫ গ্রাম প্লাবিত
জেলা প্রতিনিধি : উজানের ঢল ও বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার পানি বেড়ে কুড়িগ্রামের চরাঞ্চল এবং বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এদিকে বন্যার ঢেউ লেগেছে পাহাড়েও। কাচালং নদীর পানি বেড়ে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার অন্তত ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
কুড়িগ্রাম: বৃষ্টির পানি আর উজানের ঢলে কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। ধরলার পানি বেড়ে সেতু পয়েন্টে বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্রের পানি বেড়ে চিলমারী ও নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা।
এদিকে পাঁচদিন ধরে পানিবন্দি থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে জেলার ৯ উপজেলার লক্ষাধিক বানভাসী মানুষ। বিশেষ করে দুর্গম চরাঞ্চলের বন্যাকবলিতরা নৌকা ও ঘরের উঁচু করা মাচানে বসবাস করলেও শুকনো খাবার এবং বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়েছে। অনেক পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে পাকা সড়ক ও উঁচু বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। শিশু ও গবাদি পশুর খাদ্য সংকটে দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে বন্যাকবলিতদের।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, বন্যার্তদের জন্য ৩১৩ টন চাল, নগদ ১৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা, ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ১৮ লাখ ৯৫ হাজার শিশুখাদ্য ও ১৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকার গো-খাদ্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এবং তা বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
বগুড়া: উজানের ঢলে বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। পানিবন্দি মানুষ বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। উপজেলার নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকেছে। পাঁচশতাধিক ঘরবাড়িতে পানি উঠেছে। গত দুদিনে পানি বেড়ে নদীতীরবর্তী এলাকার ফসলের খেত তলিয়ে গেছে।
জানা গেছে, রোববার দুপুরে বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি বিপত্সীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এতে যমুনার তীরবর্তী সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বসতবাড়িতে পানি ওঠায় পরিবারের সদস্যসহ গবাদি পশু নিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে নিম্নাঞ্চলের মানুষ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ওঠায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে পাঠদান। সারিয়াকান্দি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, যমুনার পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করায় ৯৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকেছে।
সারিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি অফিস জানিয়েছে, যমুনা নদীর পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করায় উপজেলার ৫০০ হেক্টর পাট, ১৫০ হেক্টর আমন ধান পানিতে আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া ধৈঞ্চা, কাউন, তিলসহ অন্যান্য ফসল বন্যার পানিতে ডুবে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বলেন, আরো দুই-তিনদিন পর্যন্ত পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের অবকাঠামো ও তীর সুরক্ষিত, বড় বন্যা মোকাবেলার সক্ষমতা রয়েছে আমাদের। আপাতত বড় বন্যার আশঙ্কা নেই। সারিয়াকান্দি উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ২ হাজার ৭০০ বাড়িঘরে পানি ঢুকেছে।
রাঙ্গামাটি: টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কাচালং নদীর পানি বেড়ে রাঙ্গামাটির দুর্গম বাঘাইছড়ি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে উপজেলায় প্রায় ৪ হাজার মানুষ পানিবন্দি। গতকাল দুপুরে বাঘাইছড়ি পৌরসভার নবনির্বাচিত মেয়র মো. জমির হোসেন বলেন, উপজেলার ২৫টি গ্রামের প্রায় ৪ হাজার মানুষ পানিবন্দি। কয়েকদিনের টানা বর্ষণে কাচালং নদীর পানি বেড়ে বাঘাইছড়ি উপজেলার বেশকিছু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় আরো দেড় থেকে দুই ফুট পানি বেড়েছে। এভাবে বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যাবে। আমরা লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্য উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি।
এদিকে স্থানীয়রা জানান, ভারি বর্ষণে উপজেলাজুড়ে পাহাড় ধসের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে গ্রামের মানুষের মাঝেও আতঙ্ক দানা বেঁধেছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির পাশাপাশি ঘরবন্দি মানুষের সংখ্যা বাড়বে।
বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, পানি প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকায় এ মুহূর্তে ক’টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে, তা নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত। উপজেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অস্থায়ীভাবে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের বেশ কয়েকটি টিম মাঠে রয়েছে। এসব টিমের সদস্যরা বন্যায় প্লাবিত এলাকাগুলো পরিদর্শন করছেন। পাশাপাশি মাইকিং করে প্লাবিত এলাকার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
মধ্যাঞ্চলেও বন্যার শঙ্কা: উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চলমান বন্যা পরিস্থিতির মধ্যেই নতুন শঙ্কার কথা জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। সংস্থাটির বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দেশের মধ্যাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়ার সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল বলা হয়েছে, দেশের প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি সমতল বা উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবহাওয়া অফিসের গাণিতিক মডেলভিত্তিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তরপূর্বাঞ্চল এবং তত্সংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয় ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গে মাঝারি থেকে ভারি এবং কোথাও কোথাও অতিভারি বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। ফলে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা, পদ্মা, সুরমা, কুশিয়ারা, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমারসহ প্রধান নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।
এ অবস্থায় আগামী ২৪ ঘণ্টায় লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও জামালপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। এছাড়া দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার বন্যা পরিস্থিতিরও অবনতি হতে পারে।