যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ ইউরোপের সামরিক ক্ষমতাধর দেশগুলো থেকে বিভিন্ন স্কেলের শক্তিশালী ট্যাংক যাচ্ছে ইউক্রেনে। হয়তোবা পরবর্তী সময়ে যাবে কিয়েভের চাহিদা অনুযায়ী বোমারু বিমানও। সম্মিলিত উদ্দেশ্য একটিই— রুশ সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করা। কোভিডপরবর্তী কঠিন বিশ্ব পরিস্থিতিতে দীর্ঘ ১১ মাস ধরে চলছে এবং দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ।
ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের সম্ভাবনায় নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ এবং দেশটিতে রুশ আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এর বিশেষ অভিযান নাম দিয়ে শুরু করা ইউক্রেন আক্রমণ রীতিমতো ভয়াবহ এবং বিধ্বংসী যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। রুশ সেনাবাহিনীর একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপে কেঁপে উঠছে রাজধানী কিয়েভসহ অন্যান্য শহর।
রুশ সেনাবাহিনী নির্বিচারে হামলা চালিয়েছে ইউক্রেনের প্রধান প্রধান শহরের বেসামরিক স্থাপনাসহ যত্রতত্র। দখল করে নিয়েছে ইউক্রেনের চার অঞ্চল— দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝিয়া। সেসব অঞ্চলে সামরিক আইন জারি করেছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। হাতছাড়া হয়ে যাওয়া চারটি অঞ্চল ফিরে পেতে পাল্টা আক্রমণ করেছে ইউক্রেন। গত ১৮ অক্টোবর রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ অবকাঠামো। সামরিক-বেসামরিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালিয়েছে কিয়েভসহ অন্যান্য শহরে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব কামিকাজি ড্রোন বা আত্মঘাতী ড্রোন ইরান রাশিয়াকে সরবরাহ করেছে ।
এ যুদ্ধে সমর্থন আদায়ের জন্য চীন, তুরস্ক ও ইরানের দিকে ঝুঁকছে রাশিয়া । অন্যদিকে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে ন্যাটো সামরিক জোট এবং পশ্চিমাবিশ্ব। ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর ক্রমাগত আক্রমণে দেশটিতে পানি ও বিদ্যুতের সংকট চরম আকার ধারণ করেছে । বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাশিয়া ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে জ্বালানি স্থাপনায় হামলা করে ইউক্রেনে সন্ত্রাসবাদ চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভ্লোদিমির জেলেনস্কি বলেন, দেশের অবকাঠামো লক্ষ্য করে রাশিয়ার ধারাবাহিক হামলায় লাখ লাখ ইউক্রেনীয় জনগণ বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন অবস্থায় জীবনযাপন করছেন।
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বৃহৎ শক্তিগুলোর কৌশলগত অবস্থান আগামীর বৈশ্বিক রাজনীতি এবং অর্থনীতি গঠনে নিঃসন্দেহে একটি ফ্যাক্টর। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার এই আগ্রাসন মোকাবিলায় ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাবিশ্ব । যুদ্ধের শুরু থেকেই ইউক্রেনের সৈন্য বাহিনী তাদের ভূমি রুশ দখলদারদের কাছ থেকে রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ।
এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া আর্থিক ও মানবিক সহায়তা ইউক্রেনের জন্য নিঃসন্দেহে একটি আশীর্বাদ । পশ্চিমাদের দেয়া সামরিক সহযোগিতার বেশির ভাগই আসছে আমেরিকা থেকে । অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাজ্যসহ তার মিত্রদের সহয়তা ও নেহায়েত কম নয় । শুরু থেকেই যুক্তরাজ্য ইউক্রেনকে আর্থিক, সামরিক এবং মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে। একদিকে পরমাণু শক্তিধর রাশিয়া, অন্যদিকে মস্কোর মতো শক্তিশালী না হলেও পশ্চিমা মিত্রদের পাশে পেয়ে শক্তিমান কিয়েভ। আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে কানাডা, জার্মানি, যুক্তরাজ্য থেকে শক্তিশালী ও উন্নতমানের ট্যাংক ।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ইউক্রেনকে বোমারু কিংবা যুদ্ধ বিমান দিতে প্রাথমিকভাবে পশ্চিমা শক্তিগুলো সম্মত না হলেও পরবর্তীতে সরবরাহ করার সম্ভাবনা একবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না ।
সম্প্রতি কিয়েভের চাহিদা অনুযায়ী দেশটিতে অত্যাধুনিক ট্যাংক সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো । খুব শিগ্রিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউক্রেন পৌঁছাবে থেকে ৩০ টি১ আব্রামস এম । জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ এর সিদ্ধান্ত জার্মানি থেকে যাবে ১৪ টি লেপার্ড ট্যাংক। এছাড়া যুক্তরাজ্য দিবে চ্যালেঞ্জার এবং কানাডা থেকে লিওপারড নামক শক্তিশালি ট্যাংক পৌঁছাবে ইউক্রেনে । কানাডা বলেছে, রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ইউক্রেনে ভারী ট্যাংক সরবরাহে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগ দেবে তারা। রুশ আক্রমণ মোকাবিলায় ইউক্রেনকে সহায়তা করার জন্য চারটি লিওপার্ড ২ ট্যাংক পাঠানো হবে। কিয়েভ কে সাহায্য করার জন্য তৈরি আছে ন্যাটো জোট ভুক্ত অন্যান্য দেশ ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ইউক্রেন- রাশিয়া যুদ্ধে আমেরিকা , কানাডা সহ ইউরোপীয় অন্যান্য বৃহৎ শক্তিগুলোর রাশিয়া র বিপক্ষে এমন কঠোর অবস্থান এবং কিয়েভকে দিয়ে আসা এমন সাগ্রহ সমর্থন এই কঠিন কিংবা দীর্ঘ মেয়াদি যুদ্ধ কে কোনদিকে নিয়ে যাবে ? পারিস্পরিক সম্পরকের গুরুতর টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাওয়া রাশিয়া বনাম পশ্চিমা শক্তির মধ্যে এটা কি একটা ছায়া যুদ্ধ । এই ছায়া যুদ্ধের ফলাফল কি হবে ? বিশ্ব কি তাহলে আরেকটি বিশ্ব যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হচ্ছে ?
রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের আগে যখন রাশিয়া ইউক্রেন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করছিল তখনি এই ইস্যুয় বিরোধ চলছিল রাশিয়া- যুক্তরাষ্ট্রের। ইউক্রেনে হামলা চালানো হলে এরই মধ্যে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার হুমকি দিয়ে যাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। যদি ও ইউক্রেন সীমান্ত থেকে রাশিয়া সেনা সরানোর কথা বললেও সেটিকে ‘মিথ্যা’ বলে মনে করছিল যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়া যদি ইউক্রেনে হামলা চালায় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিলেও যে ছায়াযুদ্ধে জড়াবে তা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ ছিল না । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মতাদর্শ ভিত্তিক স্নায়ুযুদ্ধে জড়ালেও সরাসরি কোনো যুদ্ধে জড়ায়নি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া । তবে স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত থাকা এ দেশ দুটিই বিশ্বের অন্যতম দুই সামরিক পরাশক্তির দেশ। বলা বাহুল্য যে , সেই স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার দন্দে সংগঠিত হওয়া ভয়াবহ কোরিয় যুদ্ধ, ভিয়েতনাম নাম যুদ্ধের মত প্রক্সি ওয়ার বা ছায়াযুদ্ধ । ইউক্রেন এর পক্ষে পশ্চিমা শক্তির এই শক্ত অবস্থান আরেকটি ছায়া যুদ্ধের সুচনা করেছে তাতে সন্দেহ রাখার জো নেই ।
সামরিক দিক থেকে রাশিয়ার চেয়ে অনেক শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । প্রতিরক্ষা ব্যয়ে ও পৃথিবীর শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র । ২০২২ সালে দেশটি প্রতিরক্ষা খাতে ৭৭ হাজার কোটি ডলার ব্যয় করেছে । রাশিয়া গত বছর প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করেছে ১৫ হাজার কোটি ডলার।
আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় সৈন্য সংখ্যা ১২ লাখ ৮১ হাজার ৯০০ জন। রিজার্ভ আছে ৮ লাখ ১ হাজার ২০০ সৈন্য। রাশিয়ার সক্রিয় সৈন্য সংখ্যা সাড়ে ৮ লাখ। রিজার্ভ আছে আড়াই লাখ। সমুদ্রে আধিপত্যের ক্ষেত্রে ও এগিয়ে আমেরিকা।
ক্যারিয়ার ছাড়াও, ডেস্ট্রয়ারের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র বাকিদের থেকে অনেক এগিয়ে। দেশটির ডেস্ট্রয়ারের সংখ্যা ৯২টি, যা কিনা র্যা ঙ্কিংয়ে থাকা পরের তিনটি দেশ চীন , জাপান ও রাশিয়ার ডেস্ট্রয়ারের সংখ্যার যোগফলের সমান।
২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলে দিয়েছেন প্রতিবেশি দেশ ইউক্রেনে চলমান রাশিয়ার এই যুদ্ধের দায় যতটা ইউক্রেনের তারচে বেশি তৃতীয় কোন শক্তির । এই তৃতীয় শক্তি বলতে পুতিন কাদের বুঝিয়েছেন তা বুঝে নিতে কারো ভুল হবার কথা নয় । এই তৃতীয় শক্তি হল খোদ পরমাণু শক্তিধর পশ্চিমা বিশ্ব । ইউক্রেন এর সাথে এই যুদ্ধ চালানোয় ক্রেমলিনের মিত্র দেশগুলো ও অসন্তোষ প্রকাশ করলে ও এই যুদ্ধ চালিয়ে নিয়ে যাবেন বলে ও ঘোষণা দিয়েছেন পুতিন।
বিশ্বের দুই পরাশক্তি রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার (সঙ্গে যুক্ত ইউরোপীয় বৃহৎ শক্তি সমুহ) এই ছায়া যুদ্ধ পৃথিবীকে কোন দিকে নিয়ে যাবে তা দেখার বিষয় ।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।