ভ্রমণ

মেঘরাজ্যে নির্ঘুম জুয়াড়ি

নির্ঘুম জুয়াড়িআফজালুর রহমান, মালয়েশিয়া থেকে ফিরে:  অনেকটা স্বপ্নের মত, তবে স্বপ্ন নয়। একদম বাস্তব। সাগর পাহাড়ের দেশ মালয়েশিয়ার এক মেঘরাজ্যের গল্প। এখানে পথে হাঁটতে হাঁটতে কখনো মেঘ এসে সংগী হয়ে যায়। কখনোবা ছুঁয়ে যায়! যে পথে যাওয়া সেটিও এক আনন্দ ভ্রমন। পাহাড়ের উচু নিচু ভাঁজে ভাঁজে পরিচ্ছন্ন একমুখি পথ। চারপাশে শুধু চোখ জুড়ানো সবুজ আর সবুজ। এক পর্যায়ে এসে গাড়ির গতিপথ কেবল উর্ধমুখী হতে থাকে। বুঝতে পারলাম কোন এক উচ্চতা আমাদের আজকের গন্তব্য। জায়গাটির নাম “গ্যান্তিং হাইল্যান্ড”। সুউচ্চ এক পাহাড়ের উপরে গড়ে তোলা আধুনিক এক নগরী। রাজধানী কুয়ালালামপুরের জনবহুল কেএল সেন্টার থেকে যাত্রা শুরু করে বিরামহীন প্রায় ৪৫ মিনিট ছুটে চলেছে গাড়ি । এখান থেকে চোখে পরছে সুশৃংখল আলো জ্বল-জ্বলে এক শহর।

পৌঁছে গেছি “গ্যান্তিং হাইল্যান্ড”এর কাছে শেষ স্টপেজ। এখান থেকে চাইলে সড়ক পথেও যাওয়া যায় গ্যান্তিং’এ। তবে এ পথটি আরো বেশি জটিল, আঁকা-বাঁকা। তারচেয়ে, ‘কেবল-কার’ বেশ উপভোগ্য হবে। তাই এখানেই গাড়ি পার্ক করা হল। কেবল-কার স্টেশনের এ প্রান্ত থেকে যতদূর চোখ যায় দেখা যায় শুধুই উচ্চতার। বুঝলাম এতোক্ষণের উচ্চতায় আরোহন এখনো শেষ হয় নি। কেবল কারের এই পথও উর্দ্ধমুখী। প্রায় দশ মিনিটের ভাসমান পথ শেষে পৌঁছালাম কাঙ্খিত গন্তব্যে। স্টেশন থেকে বের হয়ে দেখি অদ্ভুত এক আবহাওয়া। চারপাশে কুয়াশায় ঢাকা। এর মাঝেই হু হু করে বইছে বাতাস। একটু পরেই হয়তো আবার পুরো স্বচ্ছ চারপাশ। বুঝতে বাকি রইলো না এটিই মেঘের রাজ্য। সুউচ্চ ভবনের উপরে লাল আলোতে লেখা ৬২০০ফিট। তার মানে এখন আমাদের অবস্থান ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬’হাজার ২’শ ফিট উপরে। পাশেই অন্য এক বোর্ডে তাপমাত্রা নির্দেশক ০৭ডিগ্রি সেলসিয়াস। খোলা আকাশের নিচে এর আগেও অনেক দাঁড়িয়েছি, সময় কাটিয়েছি, তবে ৬২০০ফিট উপরে মেঘের সাথে পাশাপাশি এমন আবহে সময় কাটানো এটিই প্রথম অভিজ্ঞতা! প্রকৃতির কথা আপাতত এ পর্যন্তই, এবার ভিন্ন কিছুর খোঁজ।

গ্যান্তিং এর সুউচ্চ ভবনের নিচে প্রসারিত পথ আর খোলা মাঠ। পুরোটাতেই পার্ক করা সারি সারি নামীদামী গাড়ি। প্রশ্ন আসতেই পারে গভীর রাতে এই উচ্চতায় এত সব গাড়ি কেন? উত্তর পাওয়া যাবে ভবনের ভেতরে যাওয়ার পর। ভেতরে এলাহি কান্ড! এই ভবন আসলে এক প্রমোত তরী। শপিং, থিম পার্ক, থিয়েটার বা সিনে হল, গান বাজনা, ডিস্কো, বার! কী নেই? তবে আকর্ষনের মধ্যবিন্দু এসব নয়। প্রধান আকর্ষন এখানকার ক্যাসিনো। ফাস্ট ওয়ার্ল্ড, ক্যাসিনো গ্যান্তিং সহ আরো নামী-দামী সব ক্যাসিনো। ফাস্ট ওয়ার্ল্ডে ঢুকেই প্রথমে আমাকে একটি সদস্য কার্ড করে দেওয়া হলো। সাথে প্রথম সদস্য হিসেবে দেওয়া হলো এখানকার হোটেলে থাকার জন্য ফ্রি টিকেট সহ আরো বেশ কিছু উপহার। ফাস্ট ওয়ার্ল্ডের জুয়োর আসরে ঢুকেই চোখ মোটামুটি চরকগাছ! ঘড়িতে সময় রাত দু’টো। কিন্তু ক্যাসিনোর প্রতিটি টেবিলে জুয়াড়িদের ভীড়। একেবারে রমরমা বলা যেতে পারে। ক্যাসিনোর মধ্যেও রয়েছে কয়েকটি ভাগ। যেতে হলো একেবারে ভেতরে ভিভিআইপি সেকশন এ । এখানে কেবল প্লাটিনাম আর ডায়মন্ড কার্ডধারীরাই যেতে পারে। আমি সবে মাত্র নতুন খেলোয়ার। আমার কার্ডটির নাম ক্লাসিক। এখানে অন্য এক পাকা জুয়াড়ী আমার স্পন্সর হলো। ভিভিআইপি টেবিল গুলোতে খেলোয়ার সমাগম রয়েছে তবে চারপাশে পিন-পতন নিরবতা।

ব্যাংকার-প্লেয়ার (এক ধরনের জুয়াখেলা) টেবিলে মনোনিবেশ করলাম। পুরোপুরি বুঝে উঠতে সময় লাগলো আমার। টেবিলে টেবিলে জোরে-শোরে চলতে থাকে জুয়া। সময়ে সময়ে টেবিলে পরিবর্তন হচ্ছে, আর খেলা পরিচালক সুরম্য ললনা। মজার কথা হলো, এই অভিজাত জুয়ার আসরে যেখানে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে জুয়াড়ীরা আসে টাকা উড়াতে, সেখানে নিয়মিতই দেখা যায় তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল বাংলাদেশের ফুলে ফেঁপে ওঠা এক শ্রেণীর অংশগ্রহন। মাঝের টেবিলে বসে বসে আমি শুধু খেলাই দেখছি। হঠাৎ দূর থেকে শুনতে পেলাম আড়মোড়া ভেঙ্গে কেউ একজন বলছে,“না রে! আজ আর হবে না। শনিতে ধরছে!” অন্যজন,“হ! আইজো হইলো না, গত কাইলো হইলো না। তয় হইবোটা কবে!!”।

ঘড়ির কাটায় রাত ৪টা বেজে ৩০ মিনিট। জুয়াড়িদের চোখে ঘুমের লেশ মাত্রও খুঁজে পাওয়া যায়না। কারণ জুয়োড় টেবিলে রাত আর দিন আলাদা কিছু নয়। সবই জুয়া। সবই বাজি। আধুনিক চিন্তা সম্পন্ন মানুষদের কাছে ভাগ্য বলে কিছু নেই। তবুও এখানে ভাগ্য খুঁজতে কেন বার বার ফিরে আসে দুনিয়ার সবচেয়ে বাস্তববাদী ও আধুনিক অভিজাত মানুষেরা? সে প্রশ্নেরও উত্তর পেয়েছি। বিত্ত বৈভবে পরিপূর্ন অথবা বিত্ত-বৈভব শুন্য একটি শ্রেণী আশা-হতাশার দোলায় চড়ে হারিয়ে যেতে চায় অন্য জগতে, ভিন্ন ভাবনায়। তারাই এখানে ছুটে আসে। জুয়োর টেবিলে বসলে সমাজ-সংসারের সব ভাবনা-চিন্তা উড়ে যায়। ভোর ৫টারও বেশ পরে জুয়োর টেবিল থেকে উঠলাম আমরা তিনজন। চক চক করছে সবার চোখ-মুখ। বিগত চার ঘন্টা আমরা পাশাপাশিই ছিলাম। তবে একবারও একজন অন্যজনের দিকে তাকানোর কথা মনে পড়েনি। কফি খেতে খেতে একজন অন্যজনের দিকে এই প্রথম তাকিয়ে দেখি চাপা এক আনন্দ। ঘটনাটি হলো আজ ব্যাংকার টেবিল থেকে আমাদের অর্জন প্রায় সাড়ে তিন হাজার রিঙ্গিত। বাংলাদেশি টাকার হিসেবে প্রায় ৬৫হাজার টাকা। এটি প্রথম দিনের গল্প। পরে আরো দু’দিন গিয়েছি। তবে সে গল্প শুনলে “গ্যান্তিং হাইল্যান্ড”এর জুয়োড় আসরের স্বাদ গ্রহনের ইচ্ছা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

সংবাদ উৎস
The Probashi

এমন আরও সংবাদ

Back to top button