নিয়ন্ত্রণ নয়, ব্যবস্থাপনাই কমাবে বন্যার ভয়াবহতা
এক্সক্লুসিভ নিউজ : বাংলাদেশ ভাটির দেশ। বর্ষায় উজান থেকে আসা পানি ও পাহাড়ি ঢলে প্রতিবছরই বন্যার দেখা মেলে এই ভূমিতে। কখনো কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় এই বন্যা। তলিয়ে যায় ফসলের মাঠ। বাড়িঘরে পানি ওঠায় ওই সময় বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষ। অনেক জায়গায় আবার নদীভাঙনে স্থায়ীভাবে ভিটেমাটি হারায় মানুষ। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাটির দেশ হওয়ায় বন্যা হবেই। দেশে বন্যার দরকার আছে। বন্যার কারণে জমিতে পলি জমে। এটি ফসলের জন্য উপকারী। জীবন ফিরে পায় প্রাণ-প্রকৃতি। খাদ্যচক্র বা প্রাণীচক্র ঠিক থাকে। তাই নিয়ন্ত্রণের চেয়ে দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলাতেই গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
বন্যায় গত বছর দেশের ৪০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। এ বছরও বন্যার কবলে পড়েছে বাংলাদেশ। যদিও তা একটু দেরিতে এসেছে এবার। তারপরও তলিয়ে গেছে মাছের ঘের, সবজি বাগানসহ শত শত বিঘা জমির ফসল। গতকাল স্কুল খুলে দেওয়া হলেও পানি না সরায় অনেক স্কুলে শিক্ষার্থীরা যেতে পারেনি। করোনাকালের এই বন্যা বেশ ভোগাচ্ছে মানুষকে।
বন্যার ক্ষতি কীভাবে কমানো যায়, এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মত হলো, ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় বাড়িঘরকে উঁচু করতে হবে। নদীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দূষণ কমাতে হবে। বন্যার সঙ্গে বসবাস শিখতে হবে। নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ইকোসিস্টেম ঠিক রেখে বাঁধ ব্যবস্থাপনা করতে হবে। সব জায়গায় বাঁধ দিলে নদীতে অধিক পলি জমবে। তাই সব জায়গায় না দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর বা ভবন বাঁচাতে বাঁধ দিতে হবে।
নদী গবেষক, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, উজানে পানি হঠাৎ ছাড়ার কারণে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। পানি ব্যবস্থাপনার জন্য উজানের দেশের সঙ্গে বোঝাপড়ার বিকল্প নেই। এ জন্য আন্তর্জাতিক নদী আইনের আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে ইকোসিস্টেম ঠিক রেখে সরকারঘোষিত ‘ডেলটা প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করতে হবে।
কৃত্রিম বন্যায় নদীভাঙন বেশি হচ্ছে বলে মনে করেন নদী ও বন্যা গবেষকেরা। তাঁদের মতে, উজানের দেশ হঠাৎ করে আটকে রাখা পানি ছেড়ে দেয় বলেই ভাটির বাংলাদেশের নদীতীরবর্তী মানুষেরা ভোগান্তিতে পড়ছে। এত পানি একসঙ্গে ধারণের ক্ষমতা নেই এখানকার নদীর। ফলে নদীভাঙনের কবলে পড়ছে তারা। প্রয়োজনের সময় পানি থাকে না। অসময়ে পানি আসছে। এভাবে সৃষ্টি হয় কৃত্রিম বন্যা, যা বেশি ক্ষতি করছে বাংলাদেশের। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক নদী আইনের মাধ্যমে উজানের দেশগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া দরকার বলে মত দিচ্ছেন তাঁরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন নদীর মুখে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এটা খুলে ফেলা দরকার। সেই সঙ্গে প্রজেক্টের নামে নদীর প্রবাহ আটকানো হচ্ছে। এটা নদীর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ফেনী নদীর মুখে মুহুরি প্রজেক্ট ও নোয়াখালীর ছিলোনিয়া নদীর মুখে যেসব বাঁধ দেওয়া হয়েছে, তা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য নষ্ট করছে। ধান ফলানোর উদ্দেশ্যে দেওয়া এই বাঁধের কারণে প্রায় ১০০ প্রকারের মাছ ওই নদী থেকে হারিয়ে গেছে। বাঁধ দিয়ে একদিকে লাভ করতে গিয়ে ১০ দিকে লোকসান হচ্ছে। বাঁধের আগের অংশে রবিশস্য হতো, এখন তা হচ্ছে না। তাঁরা বলছেন, নদীকে নদীর মতো থাকতে দিতে হবে। তার প্রবাহকে আটকানো যাবে না।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, বন্যার চেয়ে বড় সমস্যা নদীভাঙন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই ভাঙন বেশি হচ্ছে। তা ছাড়া, অবৈধ বালু তোলা, বাঁধের ওপর ঘরবাড়ি করায় বাঁধের ক্ষতি হয়। বাঁধ মেরামত ঠিকমতো হয় না। বাঁধ রক্ষায় স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করলে এটি রক্ষা করা সহজ হবে। বাঁধ নির্মাণে বারবার প্রকল্প হয়। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ নেই। কর্মকর্তাদের মাঝে বাঁধ নির্মাণে আগ্রহ আছে, রক্ষণাবেক্ষণে নেই।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বন্যাকবলিত এলাকার জেলা প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে যৌথভাবে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম। তিনি বলেন, ‘বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য মাঠপর্যায়ের কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। করোনাকালে যতটুকু সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি আমরা। দুর্যোগ মোকাবিলায় বিভিন্ন জেলায় দিনরাত কাজ করছে সবাই। কোথায়ও বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে তা সংস্কারের জন্য প্রকৌশলীদের বলা হয়েছে।’