ডেঙ্গুতে কাবু ঢাকাবাসী, সেপ্টেম্বরে আক্রান্ত চূড়ায় ওঠার শঙ্কা
ঢাকা : দেশে ধীরে ধীরে কমে আসছে করোনার প্রকোপ। দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা নেমে এসেছে চল্লিশের ঘরে। এতে জনজীবনে কিছুটা স্বস্তি ফিরতে শুরু করলেও ডেঙ্গু নিয়ে দেখা দিয়েছে ভীতি। প্রতিদিনই লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে রাজধানী ঢাকার বাসিন্দারা। কিন্তু ডেঙ্গু মোকাবিলায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম হতাশ করছে মানুষকে।
ঢাকা উত্তরে কিছু কাজ হলেও তা শুধুই লোক দেখানো বলে অভিযোগ রয়েছে। আর দক্ষিণের ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবস্থা বেশি খারাপ হওয়া সত্ত্বেও ডেঙ্গু প্রতিরোধে ডিএসসিসির কার্যক্রম নেই বললেই চলে। বিশেষ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপসের বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে নগরবাসীর মনে কাজ করছে চাপা ক্ষোভ। জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ পুরান ঢাকায় এ নিয়ে বিক্ষোভও হয়েছে।
বেসরকারি একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন সোহাগ (৩০)। গত কয়েক দিন ধরে তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি। তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ডেমরা এলাকায় থাকি। এখানে মাসে একবারও মশক নিধন কার্যক্রম চোখে পড়ে না। মাঝেমধ্যে দেখা মিললেও সেগুলো শুধু লোক দেখানোর জন্য। এসব কেরোসিন দিয়ে কাজ হয় না। মানুষ আক্রান্ত হলে কিংবা মারা গেলে নেতারা দুঃখ প্রকাশ করেন। কিন্তু দুঃখ প্রকাশ দিয়ে কী হবে? আমাদের যে ক্ষতি হচ্ছে তা কী পূরণ হবে।’
মিটফোর্ড হাসপাতালে কেমন সেবা পাচ্ছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে সোহাগ বলেন, ‘প্রতিদিনই রোগী বাড়ছে। প্লাটিলেট ১ লাখের নিচে থাকলেই যেখানে ঝুঁকি, সেখানে রোগীর চাপ থাকায় প্লাটিলেট ৫০ হাজারে এলেই রিলিজ দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালের পরিবেশ ভালো না।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি যে হিসাব, বাস্তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। আমাদের দুঃখের কথা শোনার কেউ নেই। মেয়র-কাউন্সিলরেরা নগরবাসীর খোঁজ নিচ্ছেন না।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সর্বমোট রোগী ভর্তি হয়েছেন ১৪ হাজার ২২১ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ১২ হাজার ৮৯৬ জন রোগী। বর্তমানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ভর্তি আছে ১ হাজার ২৭১ জন। ঢাকার ৪১টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১ হাজার ৮০ জন এবং ঢাকার বাইরে ভর্তি আছে ১৯১ জন। ডেঙ্গুতে চলতি বছর ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
চলতি বছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে ভয়াবহ মাসটি ছিল আগস্ট। শুধু আগস্টেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩৩ জন। আগস্টে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৬৯৮ জন। চলতি মাসেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। চলতি মাসে এ পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ৮৫৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। চলতি মাসে গত আগস্টের চেয়েও ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে পারে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, ‘ডেঙ্গু বাড়া ও কমার ধারা এটি নির্ভর করছে পরিবেশ ও আবহাওয়ার ওপর। এখনতো আবার নিম্নচাপ শুরু হয়েছে। এটি কত দিন চলবে এটির ওপর নির্ভর করছে। পুরো সেপ্টেম্বর মাস দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকবে এটি ধরে নিয়েই আমাদের অগ্রসর হতে হবে।’
এর আগে ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। সে বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ লাখের বেশি মানুষ। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ১৪৮ জনের। ২০০২ সালে ডেঙ্গুতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়, সেবার ৫৮ জন ডেঙ্গুতে মারা যান।
এবারের পরিস্থিতিও জটিলই বলতে হবে। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) সাম্প্রতিক এক গবেষণার তথ্য বলছে, বাংলাদেশের রোগীদের মধ্যে ডেঙ্গুর নতুন সেরোটাইপ বা ধরন শনাক্ত করা হয়েছে। ডেনভি-৩ নামের এই ধরনে ঢাকার বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। এই ধরনের কারণে রক্তের কণিকা প্লাটিলেট দ্রুত কমে যায়। এতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা খুব দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়েন।
ডেঙ্গুতে শিশু-তরুণেরা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, ‘ডেঙ্গুর ধরন চারটি। ডেনভি ১, ডেনভি ২, ডেনভি ৩ এবং ডেনভি ৪। যারা ১৫ বছর আগে ডেনভি ১,১২ বছর আগে ডেনভি ২ এবং ৮ বছর আগে ডেনভি ৩ ধরনে আক্রান্ত হয়েছেন তাঁরা এবার শুধু ডেনভি ৪ ধরনে আক্রান্তের ঝুঁকিতে রয়েছে। আর যারা শিশু-তরুণ তাঁরা কিন্তু এর আগে আক্রান্ত হয়নি। কিংবা আক্রান্ত হলেও একবার আক্রান্ত হয়েছে। তাই তাঁদের আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি। আক্রান্তের সংখ্যা যেহেতু বেশি তাই শিশু-তরুণদের মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি।’
ঢাকাবাসীর জন্য আগে থেকেই আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠা ডেঙ্গু এবার আরও বেশি করে চোখ রাঙাচ্ছে। সঙ্গে হাসপাতালে সিট পাওয়া নিয়ে রয়েছে সংশয়। এর মূল কারণ অবশ্য করোনা পরিস্থিতি। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী নিয়ে তার স্বজনেরা বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরছেন। নন-কোভিড হাসপাতালের ওপর অন্য রোগীদের চাপ বেশি থাকায় চটজলদি এ খোঁজ পাওয়াও যাচ্ছে না। এদিকে ডেঙ্গুর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গিয়ে কেউ কোভিড আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও স্বাভাবিকভাবে নিতে চাইছে না। ফলে আগের চেয়ে জটিল এ পরিস্থিতিতে অনেকেই ঘরে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন, যার হিসাব তথ্যভান্ডারে থাকছে না।
সার্বিক এই পরিস্থিতিতেও ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে তেমন উদ্যোগ কিন্তু দেখা যায়নি। বরাবরের মতোই এডিস মশার আবাসস্থল ধ্বংসের দিকেই মনোযোগ দিয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু এই মনোযোগটি দেওয়া হয়েছে দেরিতে। এবার বর্ষা ছিল তুলনামূলক দীর্ঘ। ফলে এডিস মশার বংশবৃদ্ধি তুলনামূলক লম্বা সময় ধরে হয়েছে। কিন্তু এডিস মশার বংশবিস্তার স্থল ধ্বংসের অভিযানটি দেরিতে শুরু করা হয়েছে। ফলে প্রয়োজন ছিল—এডিসের বংশবিস্তার স্থলগুলোর পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্ক মশা নিধনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু তেমন পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ডেঙ্গু রোধে সিটি করপোরেশনের ভূমিকা প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, ‘সমন্বিত মশক নিধন অভিযান চালাতে হবে। সিটি করপোরেশন সমন্বিত অভিযান চালাচ্ছে না। ফলে সুফল মিলছে না। এছাড়া কার্যক্রম ওষুধ ছিটিয়ে এডিসের প্রজনন ধ্বংস করতে পারলেও ডেঙ্গু কমবে।’
এই বিষয়গুলো বিভিন্ন সময় নাগরিক পরিসর থেকে দাবি-দাওয়ার মাধ্যমে তুলে ধরা হলেও বিষয়টি তেমন আমলে নেওয়া হয়নি। অন্তত কাজে তেমনটা মনে হয়নি। বছরের শুরুতেই বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো নিশ্চুপ ছিল। কিন্তু ডেঙ্গু রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। এটি একটি নতুন প্রবণতা হিসেবে সামনে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে এ ধরনের কার্যক্রমের ব্যাপক প্রচারই থাকে এর মূল লক্ষ্য। এতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের লাভ হলেও হতে পারে। কিন্তু ডেঙ্গুর বিস্তার মোকাবিলায় যে এটি তেমন কাজের কিছু নয়, তা তো পরিসংখ্যানেই প্রমাণ।
রয়েছে আরও অব্যবস্থাপনা। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত আগস্টের শুরুতে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য ছয়টি হাসপাতাল নির্ধারণ করে দেয়। এসব হাসপাতালের মধ্যে পাঁচটি রাজধানীতে ও একটি টঙ্গীতে। কিন্তু এসব হাসপাতালের মধ্যে রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল ও টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ হাসপাতালে রোগী ভর্তির ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যগুলো আছে নামেই। আর এই নামকাওয়াস্তে হাসপাতালের দায় রোগীদের চোকাতে হচ্ছে।
বর্ষা শেষ। কিন্তু বৃষ্টি এখনো হচ্ছে থেকে থেকে। আর্দ্রতা বা তাপমাত্রা এখনো মশার প্রজননের অনুকূলেই বলা যায়। ফলে এখনো স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে ব্যবস্থা না নিলে সামনে ডেঙ্গুর জন্য আরও মূল্য চোকাতে হতে পারে।