এক্সক্লুসিভ নিউজজাতীয়জীবনযাত্রাদৃষ্টি আকর্ষণলিড নিউজ

শুল্ক কমিয়ে ডিজেল ও চালে লাগামের চেষ্টা

এক্সক্লুসিভ নিউজ, ঢাকা : কমল চাল ও ডিজেলের শুল্ক। চালের দামের অস্থিরতা আর ডিজেলের দাম বাড়ানোয় পুরো বাজারব্যবস্থা যেভাবে বিশৃঙ্খল হয়েছে, তাতে লাগাম টানতেই সরকার অবশেষে চালের শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ-মূলক শুল্ক কমিয়েছে। আর ডিজেলের আগাম কর ৫ শতাংশ প্রত্যাহারের পাশাপাশি আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে গতকাল রাতে প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

এদিকে, শুল্ক কমানোর ফলে ডিজেল ও চালের দাম কতটা কমবে, তানিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ব্যবসায়ীদের দাবি মেনে শুল্ক কমানো হলেও বাস্তবে পণ্যের দাম খুব একটা কমতে দেখা যায় না। উল্টো সরকারের বিপুল রাজস্ব ক্ষতি হয়। তবে ডিজেলের দাম যেহেতু সরকার নিয়ন্ত্রণ করে, তাই এর দাম কমবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতি লিটার ডিজেলে শুল্ক কমছে ১৩ টাকার মতো। সরকার যদি ভর্তুকি না দেয় তাহলেও প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ১১৪ টাকা থেকে অন্তত ১০০ টাকায় নেমে আসার কথা। আর কিছু ভর্তুকি সরকার যোগ করলে, এর দাম আরও কমতে পারে। শুল্ক কমানোর বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকদের। কেউ বলছেন এটা ইতিবাচক। কারও মতে, জল ঘোলা করে সরকার এ পথে হাঁটছে, সুফল নিয়ে সংশয় রয়েছে।

জানা যায়, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর থেকে অস্থিরতা বিরাজ করছে নিত্যপণ্যের বাজারে। মূল্যস্ফীতির হার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। বিশেষ করে চালের ভরা মৌসুমে দাম অস্বাভাবিক। চিকন চালের চেয়ে মোটা চালের দাম বৃদ্ধির হার অপেক্ষাকৃত বেশি। সাধারণত নিম্নবিত্তের মানুষই মোটা চালের ক্রেতা। সরকারি সংস্থা টিসিবির গতকালের বাজারদর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর গত এক মাসেই মোটা চালের দাম বেড়েছে ১৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। সারা বছরে যেখানে ১৯ শতাংশ বাড়ে; সেখানে এক মাসে বাড়ার হার অনেক বেশি। এর ফলে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার চালের দাম সহনীয় করতে শুল্ক কমানোর উদ্যোগ নেয়।

এনবিআর সূত্র জানায়, সাধারণত বাজারে চালের দামে অস্থিরতা দেখা দিলে প্রথম কোপ পড়ে শুল্ক ছাড়ের ওপর। এভাবে বিভিন্ন সময়ে চালের শুল্ক সাড়ে ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে শেষ পর্যন্ত তা ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশে আনা হয়। সম্প্রতি চালের দাম আরও বাড়ায়, তা সহনীয় করতে সরকারের শীর্ষ মহলের পরামর্শে এর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে আরও ১০ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত হয়। ফলে চালের শুল্ক কমে এখন ১৫ দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এদিকে, চালের শুল্ক কমার আশায় হিলি স্থলবন্দরে চালবাহী ট্রাকের সারি লম্বা হচ্ছে। প্রজ্ঞাপন জারির পরই চালের ট্রাকের শুল্কায়ন করার ভরসায় আছেন আমদানিকারকেরা।

তবে, শুল্ক কমিয়ে বাজারে চালের দাম সহনীয় রাখার কথা ভাবা হলেও, ভারতের ইকোনমিক টাইমস জানিয়েছে, ভারত চাল রপ্তানিতে বিধিনিষেধ জারি করতে পারে। দেশটি এ আভাস দিয়েছে। ভারত প্রায় ৪০ শতাংশ চাল রপ্তানি করে। বাংলাদেশেও চাল আমদানির একটি বড় অংশ আসে ভারত থেকে। যদিও ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি।

এ ব্যাপারে সাবেক কৃষিসচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, শুল্ক কমিয়ে চালের দাম সহনীয় রাখার সিদ্ধান্তটি সময়োপযোগী। এর ফলে বাজারে সরবরাহ বাড়বে। দাম কতটা কমবে এখনো বলা না গেলেও সরবরাহ বাড়লে হয়তো দাম আর বাড়বে না। তবে, শুল্ক কমানোর সুফল যেন ডলারের দামের কারসাজির কারণে হাতছাড়া না হয় সেদিকেও সতর্ক থাকতে হবে। কারণ ডলার বাজারও অস্থিতিশীল। দেখা গেল, শুল্ক কমানো হলো, ডলার সংকট রয়ে গেল। তখন আবার এ সংকটকে পুঁজি করে যেন চালের দাম না বাড়ানো হয়।

নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় করতে চালের পাশাপাশি ডিজেলের দাম কমানোর কথা নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা চলছে। যদিও কোনো সুস্পষ্ট কিছু জানা যাচ্ছে না। তবে শুল্ক কমানোর কারণে ডিজেলের দাম কমানো হতে পারে বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, জ্বালানি তেলে লোকসানের কারণ দেখিয়ে সরকার ডিজেলসহ বিভিন্ন জ্বালানি পণ্যের দাম প্রায় ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়।

এ কারণে সরকার ব্যাপক সমালোচনা ও বিতর্কের মুখে পড়ে। একপর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের আশ্বাস দেওয়া হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ডিজেলের দাম কমানোর অংশ হিসেবে শুল্ক কমানোর পথে হাঁটে।

এনবিআর বলছে, বর্তমানে জ্বালানি তেলের মোট করভার প্রায় ৩৪ শতাংশ। এ হারে শুল্ক-কর আদায়ের ফলে গত অর্থবছরে এনবিআর এ খাত থেকে প্রায় ১১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব পায়। বর্তমানে শুল্ক ছাড়ের ফলে সরকার জ্বালানি তেল থেকে রাজস্ব হারাবে অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা।

এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এনবিআর শুল্ক কমালেও বিপিসি ডিজেলের দাম কতটা কমাবে এটা তো এখনো জানা যায়নি। এমনও তো হতে পারে বিপিসি মুনাফার অঙ্ক বাড়াবে। তবে দাম কমালে আমি মনে করি বাজারে দামের ওপর কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে তাও স্বয়ংক্রিয় ভাবে হবে না। আবার বাস-ট্রাক-লঞ্চ মালিকসহ সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তারপরও দাম ভোক্তা পর্যায়ে কতটুকু কমবে এই নিয়ে সংশয় রয়েছে।’

চালের শুল্ক কমানোর বিষয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, চালের শুল্ক কমালে বাজারে সরবরাহ বাড়বে–এমনটিই মনে করা হয়। তবে আমদানি কার্যক্রমও বড়দের হাতে নিয়ন্ত্রিত। এটা যদি সহজে সবার জন্য উন্মুক্ত থাকত তাহলে যতটা প্রভাব পড়ত, বিদ্যমান প্রক্রিয়ায় ততটা পড়বে বলে মনে হয় না।

শুল্ক কমানোর কারণে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু। তিনি বলেন, ‘এটা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। আমরা শুল্ক কমানোর দাবি করেছিলাম। এখন ডিজেলের দাম কমবে আশা করি। তবে চাল আমদানির সুযোগে ব্যাংকগুলো যাতে ডলারের কৃত্রিম সংকট না করতে পারে সে দিকে সতর্ক থাকতে হবে। যারা কারসাজি করবে তাদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে।’

এমন আরও সংবাদ

Back to top button