সম্পাদকীয়

জ্ঞাননির্ভর সমাজ গঠনে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ

বাঙালি জাতির জীবনে একটি বেদনার দিন আজ, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দেশের বিভিন স্থানে আত্মসমর্পণ শুরু করে। তারা যখন তাদের অনিবার্য পরাজয় আঁচ করে, তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এই দিনে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মেধাবী গুণীজন ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।

স্বাধীন বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও নতুন রাষ্ট্রকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে মেধাবী মানুষকে নিজ নিজ বাড়ি ও কর্মস্থল থেকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে পৈশাচিকভাবে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। ঘাতকদের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতি যাতে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বদরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।
এভাবে বহু আত্মদান ও দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পরিক্রমা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি ক্ষেত্রে এ দেশের কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী, চলচ্চিত্রকারসহ বুদ্ধিজীবীদের অপরিসীম অবদান রয়েছে। নিরস্ত্র বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত করার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর পাশাপাশি এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক বাঙালির ওপর নির্বিচারে গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের আপামর জনতার সঙ্গে বুদ্ধিজীবীরাও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু করেন। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

একাত্তরে ৩০ লাখ শহীদের মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যার ঘটনা বিশেষ জাতির ইতিহাসে তাৎপর্য বহন করে। বাঙালিকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত দিক দিয়ে পিছিয়ে দেওয়ার জন্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঘৃণ্য নীলনকশা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার প্রেক্ষাপট জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে।

স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধাপে ধাপে বহু আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে মুক্তিসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তাঁর আহ্বানে গোটা জাতি মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয় জামায়াত। গঠন করে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী। তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তার পাশাপাশি হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ চালায়।

৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধের শেষলগ্নে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল বিক্রমের মুখে হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনী আঁচ করতে পারে তাদের অনিবার্য পরাজয়। ঠিক এই সময় পরাজয়ের প্রতিশোধ এবং জাতিকে মেধাশূন্য করার হীন উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বেছে বেছে তালিকা করে দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পীসহ মেধাবী সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে। বুদ্ধিজীবীদের অবস্থান নির্ণয় এবং পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে তাদের ধরে আনার জন্য রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

পাকিস্তানি দুঃশাসনের দিনগুলোতে দেশের লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা বিবেকের কণ্ঠস্বর হিসেবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। জাতিকে পথ দেখিয়েছেন, আলোকিত করেছেন। বুদ্ধিজীবীরা লেখনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি, যুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারকে পরামর্শসহ বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টিতে কাজ করছিলেন। বাঙালির দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামে এসব বুদ্ধিজীবী নিজেদের মেধা, মনন ও লেখনীর মাধ্যমে স্বাধীনতার সংগঠকদের প্রেরণা জুগিয়েছেন। দেখিয়েছেন মুক্তির পথ। গোটা জাতিকেও উদ্দীপ্ত করেছেন অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। এ কারণেই তাঁরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের জিঘাংসার শিকার হন।

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহর থেকে বিজয়ের আগমুহূর্ত পর্যন্ত যেসব বরেণ্য বুদ্ধিজীবীকে আমরা হারিয়েছি, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন- অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশীদুল হাসান, ড. আনোয়ার পাশা, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, নিজামুদ্দীন আহমদ, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, সেলিনা পারভীন প্রমুখ।

ঢাকা শহরে রাতের অন্ধকারে তালিকা করে বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়। বিজয়ের পর রাজধানীর রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের চোখ ও হাত বাঁধা ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ উদ্ধারের পর ঘাতকদের এই সুপরিকল্পিত হত্যার নীলনকশা প্রকাশ পায়। বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড কেবল রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হতার দিন হিসেবে স্মরণ করা হলেও মূলত ১০ ডিসেম্বর থেকেই ইতিহাসের ঘৃণ্যতম এ অপকর্মের সূচনা হয়। সপ্তাহজুড়ে তালিকায় একে একে উঠে আসে অসংখ্য বুদ্ধিদীপ্ত সাহসী মানুষের নাম। পরে এসব বুদ্ধিজীবীর তালিকা তুলে দেওয়া হয় তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর সশস্ত্র ক্যাডার গ্রুপ কুখ্যাত আলবদর ও আলশামস বাহিনীর হাতে। নেপথ্যে ছিল পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলী।

মূলত ১০ ডিসেম্বর থেকেই রাতের আঁধারে তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে চোখ বেঁধে রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা শুরু হয়। আর এ অপকর্মের চূড়ান্ত নীলনকশারই বাস্তবায়ন ঘটে ১৪ ডিসেম্বর।
তাই বুদ্ধিজীবী দিবসের তাৎপর্য আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রেখে যাওয়া আদর্শ ও পথ অনুসরণ করে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক সমাজ গড়তে পারলেই তাদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে। একাত্তরের ঘাতক, মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-মৌলবাদী চক্রের সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে।

১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা ছিল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। আশার কথা হলো, ২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় এনেছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত কয়েকজন শীর্ষ অপরাধীর বিচার ও শাস্তি কার্যকর হয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দেশ বেরিয়ে আসতে পেরেছে। এটি জাতির জন্য স্বস্তিকর।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, মহান মুক্তিযুদ্ধের এই পরাজিত শক্তি পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ হত্যা করে। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করে তারা। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করে দেয় গণতন্ত্র হত্যা করে মার্শাল ল জারির মাধ্যমে। স্বাধীনতা যুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস বিকৃত করে দেয়।

এসব কারণে বুদ্ধিজীবী দিবসের তাৎপর্য ধারণ করতে হলে আমাদের অনুধাবন করতে হবে কেন এই মহৎ প্রাণ মানুষগুলো জীবন দিয়েছেন। তাঁদের চিন্তা ও আদর্শ কী ছিল। আক্ষেপের বিষয় হলো- জাতির পিতাকে হত্যার পর দীর্ঘ একটা সময় দেশের শাসনক্ষমতা ছিল ঘাতকদের হাতে। সে কারণে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ ধারণ ও লালনের পরিবেশ ছিল না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর থেকে নতুন প্রজন্ম জানতে পারছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। একাত্তরে বিজয়ের প্রাক্কালে বুদ্ধিজীবীদের হারানো ছিল জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। এই ক্ষতি পুষিতে নিতে সরকার মনোযোগ দিয়েছে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের রেখে যাওয়া আদর্শকে পাথেয় করে আগামীর বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। এই পথ ধরেই একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও জ্ঞাননির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ গড়ে উঠবে- এই আমাদের প্রত্যাশা।

সুলতানা রাজিয়া পান্না

পরিচালক, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন ও পরিকল্পনা, রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়

এমন আরও সংবাদ

Back to top button