দেশব্যাপী ডেঙ্গু ইস্যুতে উদ্বিগ্ন না হয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা। এডিস মশার লার্ভা যাতে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়, সেজন্য একদিনের বেশি ঘরের স্বচ্ছ পাত্রেও পানি জমিয়ে না রাখতে পরামর্শ তাদের। বলছেন, সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া ডেঙ্গুর এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি থেকে বাঁচার উপায় কম।
কারণ এডিস মশাবাহিত এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা গত কয়েক দিন ধরে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে। সংক্রমণের এই হার যেন জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার আওতাধীন জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বছরে তিনবার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় মশা জরিপ করে। প্রাক্-বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষা-পরবর্তী জরিপ। চলতি বছরের এপ্রিলে বর্ষা-পরবর্তী জরিপ করা হয়। তাতে ঢাকার কোনো কোনো এলাকার ১০ শতাংশ বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গিয়েছিল। তখনই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আশঙ্কা করে, এ বছর ডেঙ্গু রোগী বাড়তে পারে। বর্তমানে ডেঙ্গুর আওতা বেড়েছে বলেও দুই সিটির সঙ্গে আলাপে জানা গেছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা প্রফেসর ডা. মোজাহেরুল হক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ডেঙ্গু মশার ধরন বদলায়েছে। এখন শুধু সকাল এবং সন্ধ্যায় কামড়াচ্ছে না, দিনের যে কোনো সময় কামড়াতে পারে। স্বচ্ছ আলোয় যেসব মশা জন্ম নিচ্ছে, ওই মশাগুলো রাতেও কামড়াচ্ছে। ফলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তিনি বলেন, মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছাড়াও ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, পীতজ্বর, জিকার মতো জটিল রোগ সংক্রমিত হতে পারে। তাই আমাদের সকলকে মশা নিধনের বিষয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। এডিস মশা পরিষ্কার ও স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে। অপরিষ্কার, ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে মশা ডিম পাড়ে না। তাই আমাদের চারপাশের কোথায় স্বচ্ছ পানি জমে আছে, তা লক্ষ রাখতে হবে। শহর অঞ্চলে অনেকেই শখ করে ছাদে বিভিন্ন ফুল-ফলের গাছ লাগিয়ে থাকেন। অনেকে আবার অনেক অপ্রয়োজনীয় বালতি, বোতল ছাদে ফেলে রাখে বা প্রয়োজন হেতু মজুত করে। ঘর সাজানোর জন্যও পানিভর্তি ফুলদানি রাখে ঘরের ভেতরে। পানি জমে থাকা এসব পাত্র ভালোমতো ও নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। কারণ, পাত্রে থাকা পানিতে মশার লার্ভা থাকতে পারে, যা থেকে ডিম ফুটতে পারে। এছাড়া ঝোপঝাড় ও নালায় মশার জন্ম হয়। তাই বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড় ও নালা-নর্দমা পরিষ্কার রাখতে হবে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডাক্তার মুশতাক হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রতি বছরই ডেঙ্গু হচ্ছে, ভাবছি আগামী বছর হবে না। একটা সাময়িক ব্যবস্থা করে সন্তুষ্ট থাকছি। সিটি করপোরেশনের এত কম জনবল দিয়ে ডেঙ্গু মোকাবিলা করা যাবে না। সিটি করপোরেশনের লোকজন শুধু কীটনাশক প্রয়োগ করছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারকে মূল উদ্যোগ নিতে হবে। তাতে ঘাটতি রয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার এ প্রতিবেদককে জানান, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আগামী মাসে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়বে। শুধু ঢাকায় নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় এবং পৌরসভায় সবারই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। নগরবাসীকে এ ব্যাপারে খুব সচেতন হতে হবে। নগরবাসী বা জনসাধারণ যারা রয়েছেন তাদের নিশ্চিত করতে হবে যাতে তাদের বাড়ির আঙিনায় কোথাও পানি জমে না থাকে যেখানে এডিস মশার জন্ম হতে পারে। জনগণ, সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও গণমাধ্যম সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলে হয়তো আমরা এ সমস্যাটাকে মোকাবিলা করতে পারব। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৮৪ জন। মারা গেছেন একজন। দেশে কোনো বছরের জুলাই মাসের শুরুতেই ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ রূপ আর কখনো দেখা যায়নি। তিনি বলেন, এখানে অনেক কারণ রয়েছে। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রার বৃদ্ধি বা জলবায়ু পরিবর্তন তার একটি কারণ। ডেঙ্গু সংক্রমণ শুধু বাংলাদেশে হচ্ছে, ব্যাপারটি এমন নয়। এ বছর এরই মধ্যে লক্ষাধিক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ব্রাজিল, বলিভিয়া, পেরু ও আর্জেন্টিনায়। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কায়ও আক্রান্তের সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। সাম্প্রতিক দশকে বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০০ সালে থেকে বর্তমান সময়ে ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ গুণ। ফিলিপাইনে ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩১ শতাংশ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষণবিহীন বা হালকা জ্বর ও বাসায় চিকিৎসা নেওয়ার কারণে রিপোর্টিং হচ্ছে কম। একটি গবেষণা থেকে ধারণা মিলেছে বিশ্বব্যাপী প্রায় চার কোটি মানুষ ডেঙ্গু-সংক্রমণ ঝুঁকিতে আছে। সব মিলে এখানে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক প্রভাব রয়েছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে ডেঙ্গুঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা পরিবর্তিত পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ডেঙ্গু ভাইরাসের সম্পর্ক নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা না থাকলেও এটি অনুমান করা যায় যে, করোনাভাইরাসের মতো এটিও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে পরিবর্তন করে নিতে সক্ষম।
উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম শফিকুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা সারা বছরই পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। এ বছর শুরু থেকেই আরও বেশি সর্তক হয়ে কাজ করছি। গত বুধবার থেকে উচ্চ ভবনগুলোতে যেখানে ছাদ বাগান আছে সেখানে ড্রোনের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করছি কোথায় কোথায় পানি জমে আছে। এছাড়াও জনসম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক লেলিন চৌধুরী প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যে মশানিধক ওষুধ ছিটানো হয় তা কার্যকর নয়। ফলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। এটা উদ্বেগের। এ বিষয়ে সরকারের নজরদারি বাড়ানো উচিত।