ভ্রমণ

পূর্ণ জোসনায় হেসে উঠে হিজল বন

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর হাওর বাওর আর নদী বেষ্টিত বাংলার অপরূপ এক জেলা কিশোরগঞ্জ। যা পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, কালনী, ধনু, নরসুন্দা, বাউরি, ঘোড়াউত্রা নদ নদী দিয়ে ঘেরা। আমরা জানি সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা, বি-বাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জ মোট সাতটি জেলা মিলে হাওর অঞ্চল। এখানে ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে রয়েছে বিশাল আকারের ১২২ টি হাওর। হাওরে শুষ্ক মৌসুমে মাইলের পর মাইল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর ফসলি জমি আর ধূলিওড়া মেঠোপথ। শুষ্ক মৌসুমে পুরো হাওর যেন নেচে নেচে গান গেয়ে উঠে সবুজের খেলায়। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে অতিথির দল। সাদা বক খেলা করে, উড়ে যায় দূরে, কান পাতলেই শুনা যায় ডাহুক, পানকৌড়ি কিংবা জলময়ূরের ডাক।

বলা হয়ে থাকে- শুকনায় পাও, বর্ষায় নাও। এখানে বর্ষা থাকে বছরে প্রায় ছয় মাস। পানি আসতে শুরু করে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে আর শেষ হয় আশ্বিন কার্তিকের মাঝামাঝি সময়টাতে। বর্ষায় এই কূলহীন হাওর হয়ে উঠে সুবিশাল সাগর। সংস্কৃতি শব্দ ‘সাগর’ থেকে হাওর শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। যেমন সাগর- সাওর-হাওর।

এশিয়ার বৃহত্তম এবং বাংলাদেশের সব চেয়ে বড় হাওরটির নাম হাকালুকি। হাকালুকি মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলায় অবস্থিত। কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার কাটখাল ইউনিয়নে হিজল বনে ঘেরা এক মনোরম স্থান ‘দিল্লির আখড়া’। চারশ বছরের পুরোনো এই দিল্লির আখড়া নিয়ে নানান গল্প আছে স্থানিয়দের কাছে। এখানে বর্ষায় হাওরের পানিতে জেগে থাকে শত শত হিজল গাছ। মূলত ভরা বর্ষায় হাওরের যৌবন আসে। যৌবতী হাওরের জল দুই তীর ছাপিয়ে প্লাবিত করে ফসলি মাঠ, ঘাট, বাট। প্রতি বর্ষায় ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে এই হাওর। চারদিকে শুধু বিপুল পানিরাশি আর হাওর জুড়ে গলা ডুবিয়ে বসে থাকে হিজল গাছের সারি। মরা নদীগুলো হয়ে উঠে জল যৌবনা। পূর্ণ জোছনায় হিজল বন হেসে উঠে কথা বলে অবিকল মানুষ মতো।

কবি, অভিনেতা রিফাত চৌধুরী তখন ঢাকায় আর আমি ময়মনসিংহ। আমাদের মুঠোফোনে কথা হলো। ওপাড় থেকে রিফাত চৌধুরী বললেন আপনি ময়মনসিংহ থেকে সোজা কিশোরগঞ্জ চলে আসেন, আপনার ভাবি বাসায় নেই। বাসা খালি আছে। চলে আসেন চুকিয়ে আড্ডা হবে, রিফাত চৌধুরী মধ্যআশির একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি। কবির সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই তিনি আমাকে জীবনানন্দ দাশের সাথে তুলনা করে আসছেন এবং সবসময়ই আমাকে আপনি আপনি করে সম্বোধন করে বিব্রত করে ফেলেন। তুমুল আড্ডাতুর একজন কবি রিফাত চৌধুরী। কথা মতো রিফাত চৌধুরীও ঢাকা থেকে বাসে উঠেছেন কিশোরগঞ্জ আসার জন্যে আর আমি তখনো ময়মনসিংহ, সাইদুল ভাইয়ের কারখানায়। ময়মনসিংহের সাধারণ মানুষের সাথে মিশে আছি।

সাইদুল ভাই পুরো চার পাঁচ দিন আমাকে নিয়ে ঘুরলেন ময়মনসিংহের গ্রামীন মেঠোপথে। আমি চলে যাচ্ছি শুনে সাইদুল ভাইয়ের মুখটা কেমন জানি বিষাদ মাখা হয়ে গেলো। সাইদুল ভাইকে আমি কথা দিয়ে আসলাম আবার কোনো এক ফাল্গুনে যাবো তাই রিফাত ভাইয়ের কথামতো শম্ভুগঞ্জ থেকে বাসে চলে এলাম গাইটাল কিশোরগঞ্জ। বাসস্ট্যান্ড এসে দেখি আমার আসার অনেক আগেই চলে এসেছেন রিফাত ভাই এবং আমার অপেক্ষায় বসে বসে একের পর এক চা সিগারেট খেয়েই যাচ্ছেন। আবার অনেক দিন পর রিফাত ভাইকে পেয়ে চা খেতে খেতে তার পুরোনো একটি কবিতার চরন মনে হয়ে গেল।

“ডাকাত করছে চোরের বিচার”

আমি কিশোরগঞ্জের মাটিতে পা রাখতেই শুনলাম একটি খুন হয়ে গেছে কিশোরগঞ্জ শহরে। আমাদের দেশে ইদানিং মানুষ খুন, গুম হওয়া খুবই স্বাভাবিক বিষয়। ময়মনসিংহের লেখক হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন- ‘পৃথিবীতে একটি মাত্র প্রজাতি আছে যে প্রজাতি নিজ প্রজাতিকে খুনও করতে পারে আবার বাঁচাতেও পারে সে প্রজাতিটির নাম হলো মানুষ’। কিশোরগঞ্জ শহরের রাস্তা ঘাটে তখন মানুষের ভীড়। আমি কিশোরগঞ্জ আসছি শুনে ছড়াকার আহমেদ ফরিদ ও আহমেদ আমিন রাতেই আমার সাথে দেখা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেন।

কিশোরগঞ্জে রিফাত ভাইয়ের বাসাটি খুবই পরিপাটি। একদম উপরের তলায় বাসা, সাথে ছাদ। রিফাত ভাইয়ের ভাষ্যমতে ঢাকা শহরে এমন নিরিবিলি বাসা পাওয়া খুবই মুশকিল, আর পেলেও অনেক টাকা বাসা ভাড়া গুনতে হয়। রাতে নিজেরাই রান্না শেরে নিলাম। ভাত, ডিম, শুটকি, আলু ভর্তা। ডাইনিংয়ে বসে অনেকটা সময় ধরে তৃপ্তি নিয়ে খেলাম। তারপর বেলকুনিতে বসে আমাদের ধূমায়িত আড্ডার সাথে সাথে রাতও গভীর হতে থাকলো। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি রিফাত ভাইয়ের একজন অনুরাগী নাম কেন্দুয়া। কেন্দুয়া নেত্রকোনা থেকে বোতল ভর্তি জল নিয়ে আসলেন। দেখলাম জল আনতে পেরে খুবই তৃপ্তি পাচ্ছেন কেন্দুয়া।

রিফাত চৌধুরী মূলত স্রোতের বিপরীতে থাকা কবি। আর অভিনয় তার একমাত্র পেশা যা তিনি একমাত্র জীবিকার জন্যেই করে থাকেন। যৌবনে তার সব থেকে বেশি ঝোঁক ছিলো রাসিয়ার প্রতি, ভরা যৌবনে তিনি বার বার রাশিয়ার প্রেমে পড়েন, সেই প্রেম থেকেই তার বড় ছেলের নাম রাখেন রাসান। অভিনয় ছাড়া তার পুরোটা জীবনই কবিতাময়। একরাতে আশুগঞ্জের একটি হোটেল অহনাতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম আমরা তখন তিনি আমাকে বললেন…

পাহাড়ের সুরঙ্গ পথে রাসিয়া থেকে একটি ট্রেন ছেড়ে যায় চিনে এবং চীন থেকে যায় রাসিয়া। আপনার যদি কখনো ভ্রমণের সুযোগ হয় তাহলে ঐ ট্রেন ভ্রমণ নিয়ে একটি লেখা লিখতে পারেন। যৌবনে এই আড্ডাবাজ কবি সব থেকে বেশি সময় দিতেন আব্দুল মান্নান সৈয়দ, শহীদ কাদরীদের মতো কবিদের সাথে রিফাত চৌধুরীর সাম্প্রতিক কালের একটি কবিতার নাম প্যারিস রোড।

ছবির হাটের গেইট দিয়ে ডুকে ডান দিকে একটা রোড- প্যারিস রোড।

প্যারিস রোডে কেটে গেল এতোগুলি দিন!

একটা আস্ত জীবন!

পাগুলি সব ছুটছে প্যারিস রোডে।

অন্ধকার ভেঙে, ঝোপঝাড় মাড়িয়ে, প্রতিদিন প্রতিনিয়ত।

সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে সন্ধ্যা,

সন্ধার পর রাত ক্রমশ অনেক রাত।

এখন সম্ভবত রাত বারোটা হবে। সম্ভবত বললাম কারণ।

এখানে আবার সময়-টময় সব কেমন গুলিয়ে যায়।

মনের সঙ্গে মস্তিষ্ক মিশিয়ে বানাই একগুচ্ছ রজনীগন্ধার স্টিক।

আঙ্গুলের ফাঁকে একটার পর একটা স্টিক জ্বলছে।

মুখের কালো গহবর থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরুচ্ছে

রেডিও পয়েন্ট থেকে গানের গন্ধ ভেসে আসছে।

পারুলি কেন বদ, বদমান হলো!

এবার খুব কাছ থেকে দেখে এলাম টাঙ্গুয়ার হাওর। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তর বিভাগ সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত একটি হাওর। প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এ হাওর বাংলাদেশর দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি হিসেবেই বেশ পরিচিত। স্থানীয় লোকজনের কাছে এ হাওরের আরেকটি নাম নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল। টাঙ্গুয়ার হাওর মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। মেঘালয় পাহাড় থেকে প্রায় ৩০টিরও বেশি ঝরনা এসে মিলিত হয়েছে এই হাওর জলে।

এক সময় গাছ-মাছ-পাখি আর প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের আধার ছিলো এই হাওর। এখনো সৌন্দর্যের কোনো কমতি নেই। শীত কালে এখানে কৃষকেরা পানি শুকিয়ে যাওয়া অংশে রবিশস্য ও বোরো ধানের আবাদ করেন। এ অঞ্চলের মানুষ মূলত জীবিকা নির্বাহ করে কৃষি কাজ ও মাছ মেরে আবার ভরা বর্ষায় থৈ থৈ পানিতে নিমগ্ন হাওরের জেগে থাকা উঁচু কান্দাগুলো হয়ে উঠে পরিযায়ী পাখির আশ্রয়কেন্দ্র —পাখিরা তখন দল বেধে রোদ পোহায়, জিরিয়ে নেয়।

কবি, গীতিকার কাজী বর্ণাঢ্যের জন্মভূমি সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলায় হলেও তিনি বেড়ে উঠেছেন তার নানুর বাড়ি আশুগঞ্জে এবং দীর্ঘ দিন তার কর্মক্ষেত্র ছিলো নরসিংদী। আমি নরসিংদীর মানুষ, গান কবিতা পছন্দ করি তাই এই কবির সাথেও আমার দীর্ঘ সম্পর্ক গড়ে উঠে। তিনি দীর্ঘ দিন ধরেই আমাকে নিয়ে হাওরে ঘুরেবেড়াতে চান। তাই তার কথা মতো একদিন হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিট কেটেও ঐরাতে আর যাওয়া হলো না। ঠিক তারপরদিন দুপুরবেলা শুনলাম ডুবে গেছে হাওর, মানুষের বসতভিটার সাথে ডুবে যাচ্ছে কুকুর বিড়ালসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণিকূল। ডুবে গেছে সিলেটের আশিরভাগ ভূমি, তলিয়ে যাচ্ছে সিলেট শহর। ঝড়ঝাপটায় পানির সাথে বড় বড় ইন্ডিয়ান গাছ ভেঙে ডুকে গেছে বাংলাদেশের সীমারেখায়। চেরাপুঞ্জির একদিনের বৃষ্টিপাতের রেকর্ড গত একশত বাইশ বছরের রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে গেছে। গত একশত বাইশ বছরেও এতো বৃষ্টিপাত বা এতো পাহাড়ি ঢল হয়নি। অথচ যেদিন বন্যা শুরু হলো সেদিন রাতেই হাওর দেখতে যাবো ভেবেছিলাম।

তার কিছুদিন পর কবি আবার আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন। সুনামগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় একটি রোমান্টিক গান লিখে পাঠালেন।

ভাসাইবাম আনন্দের বেলা

কংস গাঙে খেলবাম খেলা

খেলতে যদি আউশ লাগে

শখি অইয়া আও

তোমায় লইয়া ভাইসা জাইয়াম

ভাটির কোন গাঙ….

এই গান শুনে আর মন ঠিক রাখতে পারিনি তাই তার কথামতো সোজা চলে এলাম ধর্মপাশায়, কিছুদিন আগে এখানকার একজন গীতিকার মারা গেছে। তার লেখা একটি গান আমি প্রায়শই শুনতাম নেত্রকোনার কবি নির্মলেন্দু গুণের ভক্ত সাধু পুরুষ নাভেদ আফ্রিদির কণ্ঠে। গানটির কথা এমন-

পারভেইছারে তবা কইরা বল খেলাডা ছাড়

আমি তরে না করতাছি পাগলও ছাত্তার

তবা কইরা বল খেলাডা ছাড়…

সুনামগঞ্জের মাটি প্রকৃতপক্ষে সংগীত রচনার পূর্ণ ভূমি এই পূর্ণভূমিতেই জন্ম হয়েছে বহু বাউল সাধক গীতিকারদের তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য কয়েকজন হলেন- রাধারমণ, শাহ্ আব্দুল করিম, দূরবীন শাহ্, হাছান রাজা।

এমন আরও সংবাদ

Back to top button