আকাশভরা সূর্যতারা কিংবা বিশ্বভরা প্রাণের মতোই আপন সৃষ্টির আলোয় উজ্জ্বল সেই বিশ্বকবি। মানব মনের অন্ধকার দূর করতে তিনি আলোর বীণা হাতে তুলে নিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘আঁধারে দুয়ারে তব বাজিয়েছিনু বীণা’। গানের সুরে, কবিতার পঙ্ক্তিমালায়, মানবিক ভাবনায় অথবা স্বদেশ চেতনায় তিনি বাঙালির নিত্যসহচর। সংকটে-সংগ্রামে, আনন্দ-ভালোবাসায় হয়েছেন অনুপ্রেরণার সঙ্গী। সেই কৃতজ্ঞতার বন্ধনে সোমবার পঁচিশে বৈশাখে উদ্্যাপিত হলো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬২তম জন্মজয়ন্তী। সংঘাত, ধর্মান্ধতা ও উগ্রপন্থার আস্ফালনে মানবতার সংকটে সারাবিশ্ব যখন প্রকম্পিত সেই দুঃসময়ে জন্মদিনে আরও বেশি প্রাসঙ্গিকতায় সামনে এলেন রবীন্দ্রনাথ। ভালোবাসার বন্ধনে সহজাতভাবেই রবীন্দ্র অনুরাগীদের মনে গুঞ্জরিত হয়েছে ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর/কেমনে পশিল প্রাণের পর/কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান …।’
সেই প্রেরণায় মূঢ়তা, অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে উচ্চারিত হয়েছে তাঁরই বাণী, ‘অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে…।’ মানবতা ও সম্প্রীতির মর্মবাণীকে ধারণ করে উদ্্যাপিত হলো রবীন্দ্রজয়ন্তী।
নানা আয়োজনে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের উদ্যাপিত হলো বিশ্বকবির জন্মদিন। সেসব আয়োজনে ক্রান্তিকালে কবির সৃষ্টির মাঝে খোঁজা হয়েছে অভয় বাণী। তার গান বা কবিতা থেকে সন্ধান করা হয়েছে সংকট উত্তরণের পথরেখা। এভাবেই সংকটকালে হৃদয়ের গহিন থেকে উৎসারিত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করা হয়েছে কবিগুরুকে। বাঙালির চিন্তা-মননের সঙ্গী এবং শিল্প-সংস্কৃতির অগ্রদূত কবিকে জানানো হয়েছে বন্দনা। জন্মদিনে কবি বন্দনার পাশাপাশি ছিল তার দেখানো পথ অনুসরণ করে হিংসা-বিদ্বেষ দূরে ঠেলে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পথে চলার প্রত্যয় গ্রহণ। এছাড়া কবির রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ প্রবন্ধ, নিবন্ধ কিংবা জন্মদিনের শুভাশিষ জানানো প্রতিবেদন। সরকারি-বেসরকারি চ্যানেলগুলো দিনভর প্রচার করেছে রবীন্দ্র সৃষ্টিস্নাত নানা অনুষ্ঠানমালা।
এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠানটি হয় রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য নওগাঁর পতিসরে। এ ছাড়াও জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে বিশ্বকবির স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের শাহ্জাদপুর এবং খুলনার দক্ষিণডিহি ও পিঠাভোগে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে উদ্্যাপিত হয়েছে কবির জন্মদিন। এছাড়া রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কবির চিত্রশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। সকালের বাংলা একাডেমির আয়োজনে আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনার আয়োজনে রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৩ প্রদান করা হয়। এদিন থেকে ছায়ানটের আয়োজনে শুরু হলো দুই দিনব্যাপী রবীন্দ্র উৎসব। গানে গানে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্্যাপন করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। এ আয়োজনে রবীন্দ্রনাথের জন্ম-সৃষ্টির গানগুলোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়।
বাংলা একাডেমির আয়োজন : দিবসটি উদ্যাপনে বাংলা একাডেমির আয়োজনে আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র-গবেষণায় সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশিষ্ট শিল্পী শীলা মোমেনকে বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৩ প্রদান করা হয়। পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকের হাতে সনদ, সম্মাননা-স্মারক ও পুরস্কারের অর্থমূল্য দুই লাখ টাকার চেক তুলে দেন অতিথিরা। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। একক বক্তৃতা করেন রবীন্দ্র গবেষক অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করেন বাচিকশিল্পী মাহিদুল ইসলাম ও সায়েরা হাবীব। রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী বুলবুল ইসলাম ও কমলিকা চক্রবর্তী।
একক বক্তৃতায় অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন বলেন, রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে জমিদারতন্ত্রের মিথ আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আগাগোড়া একজন স্বনির্মিত মানুষ। তিনি পারিবারিক ব্যবসায়ের সূত্রে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এসেছেন; এসব অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা যেমন করেছেন তেমনি পূর্ববঙ্গের এই সাধারণ মানুষই তাঁর সাহিত্যকে দান করেছে নতুন গতিপথ।
মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, রবীন্দ্রনাথ আমাদের শান্তি, সমৃদ্ধি ও মঙ্গলের বাতিঘর। আমরা রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য এবং জীবন থেকে পাই সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার এবং ঋদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয় প্রেরণা।
সেলিনা হোসেন বলেন, রবীন্দ্রনাথ আমাদের ব্যক্তিগত এবং জাতীয় জীবনজুড়ে ব্যাপ্ত আছেন। তার চিন্তা ও মানবিক আদর্শ আমাদের চলার পথকে কুসুমাস্তীর্ণ করে, আলোকের ঝর্ণাধারায় হাত ধরে নিয়ে চলে।
রবীন্দ্র-পুরস্কারপ্রাপ্তির অনুভূতি প্রকাশ করে শীলা মোমেন বলেন, বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র পুরস্কার-প্রাপ্তি এক জীবনের অনন্য অর্জন। রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করে তাকে অন্বেষণ করে চলেছি; এ অন্বেষণের যেন কোনো শেষ নেই, আছে আনন্দধারায় অনন্ত অবগাহন।
শিল্পকলা একাডেমির বহুমাত্রিক আয়োজন : রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্্যাপনে বহুমাত্রিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। ঢাকার পাশাপাশি কবিগুরুর স্মৃতি বিজড়িত জেলাসহ সারাদেশে একযোগে অনুষ্ঠিত হয় ‘রং তুলিতে বিশ্বকবি’ শীর্ষক আর্ট ক্যাম্প। শিল্পকলা একাডেমি ঢাকা, শিলাইদহের কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর, নওগাঁর পতিসর, খুলনার দক্ষিণডিহি ও পিঠাভোগসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় অনুষ্ঠিত হয় এই চিত্রশিবির। এতে অংশ নেন বিশিষ্ট ও বরেণ্য চিত্রশিল্পীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুশিক্ষার্থীসহ ৬০ জন শিল্পী। আর্টক্যাম্পে বিশিষ্ট ও বরেণ্য শিল্পীদের রং-তুলিতে উঠে আসে বিশ্বকবির জীবন দর্শন, সাহিত্য, গান ও কবিতার নানান বিষয়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলে এই আর্ট ক্যাম্প। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার সৃষ্টিকমের্র ওপর সৃষ্ট এসব চিত্রকর্ম নিয়ে আগামী ১৪ মে পর্যন্ত একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার ৪ নং গ্যালারিতে চলবে চিত্রকর্ম প্রদর্শনী।
সন্ধ্যায় একাডেমির নাট্যশালায় আলোচনা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় অংশ নেন প্রাবন্ধিক ও শিশু সাহিত্যিক ড. সরকার আবদুল মান্নান এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মাহফুজা হিলালী। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।
সাংস্কৃতিক পর্বে শুরুতেই ‘রিমঝিম ঘন ঘন রে’ শীর্ষক সমবেত সংগীত পরিবেশন করে একাডেমির শিশু সংগীত দল। একক সংগীত পরিবেশন করেন বুলবুল ইসলাম, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, অদিতি মহসিন, স্বাতী সরকার, কমলিকা চক্রবর্তী, আজিজুর রহমান তুহিন, তানজিনা তমা, চঞ্চল খান ও সুমা রায়। বাচিকশিল্পী শিমুল মুস্তাফা আবৃত্তি করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাঁশি’ শিরোনামের কবিতা। ‘ভেঙেছে দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়’ ও ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’ শীর্ষক গানের সুরে সম্মেলক নৃত্য পরিবেশন করে ধৃতি নর্তনালয়। কবিরুল ইসলাম রতন পরিচালনায় ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ ও ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে’ গানের সুরে দুটি নৃত্য পরিবেশিত হয়। এছাড়াও অনুষ্ঠানে সমবেত নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যালোক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নৃত্যশিল্পীরা।