কুড়িগ্রামে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি
এক্সক্লুসিভ নিউজ, কুড়িগ্রাম : রৌমারী ইউএনও আশরাফুল আলম রাসেল বলেন, ‘জিআরের বরাদ্দ থেকে ৩ লাখ টাকার শুকনা খাবার কেনা হয়েছে। এগুলো দ্রুত পানিবন্দি মানুষের মধ্যে সরবরাহ করা হবে। আরও বরাদ্দের জন্য জেলা প্রশাসককে জানানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই বিতরণ করা হবে।’
টানা বৃষ্টি আর ভারতের আসাম থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কুড়িগ্রামের দুই উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। জেলার জিঞ্জিরাম, কালোর ও ধরণী নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় তিন দিন ধরে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
রৌমারী উপজেলা পরিষদ থেকে জানা গেছে, ঢলের পানিতে রৌমারী ও চর রাজিবপুর উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ৫৫ গ্রামের ৫০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ডুবে গেছে ৫৯২ হেক্টর ফসলি জমি। এ ছাড়া ৫৬ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়ক তলিয়ে গেছে।
রৌমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কাউয়ুম চৌধুরী জানান, অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে এ পর্যন্ত উপজেলার ৫৯২ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে আউশ ধান ১৪৭ হেক্টর, পাট ২২৩ হেক্টর, ২২২ হেক্টর শাক-সবজি ও তিল তলিয়ে গেছে।
রৌমারী উপজেলা উপসহকারী প্রকৌশলী মেজবাহ আলম বলেন, ‘ঢলের পানিতে উপজেলার ৫৬ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়ক পানিতে তলিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই উপজেলার ৪০টি স্কুলে পাঠদান সাময়িক বন্ধ রয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছে শিক্ষার্থীসহ বানভাসীরা। দুর্ভোগ এলাকায় দেখা দিয়েছে গোখাদ্যের সংকট। এরই মধ্যে কবলিতদের মাঝে সরকারি-বেসরকারি সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
রৌমারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জানান, বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে ৪০টি বিদ্যালয় পানিবন্দি হয়ে পড়ায় সাময়িকভাবে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। পানি কমে গেলে নিয়মিত পাঠদান শুরু হবে।
সরেজমিনে রৌমারীর যাদুরচর ইউনিয়নের পুরাতন যাদুরচর, কাশিয়াবাড়ী, লালকুড়া, বিক্রিবিল, চর লাঠিয়ালডাঙ্গা, বালিয়ামারী, শ্রীফলগাতি, খেওয়ারচর, বকবান্দা, আলগারচর, পাহাড়তলী, যাদুরচর পূর্বপাড়া, তিনঘড়িপাড়া ও বকবান্ধা গ্রামের বাড়িগুলোতে পানি ঢুকেছে।
এ ছাড়া রৌমারী সদর ইউনিয়নের বাওয়াইরগ্রাম, ঝাউবাড়ি, দুবলাবাড়ি, পাটাধোয়াপাড়া, রতনপুর, বামনেরচর, কলাবাড়ি, বড়াইবাড়ি,নতুন চুলিয়ারচর,উত্তর বারবান্দা, মির্জাপাড়া, ইজলামারী, ফুলবাড়ি, চুলিয়ারচর, চরবারবান্ধা, ভুন্দুরচর, নয়ারচরসহ অনেক গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
একই চিত্র শৌলমারী ইউনিয়নের গয়টাপাড়া, কলমেরচর, বেহুলারচর, চরেরগ্রাম, চরবোয়ালমারীর ও দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের ধর্মপুর, কাউয়ারচর, ডিগ্রীরচর, পূর্বকাউয়ারচর বাঘেরহাটে।
এদিকে চর রাজিবপুর উপজেলার বন্দবের ইউনিয়ন ও চর রাজিবপুর ইউনিয়নের ৫ থেকে ৬টি গ্রামের মানুষও পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
ঢলে ভেসে গেছে জমিতে থাকা খড় ও মাছের ঘের। পানিতে তলিয়ে গেছে কৃষকের ধান, পাটসহ নানা ফসলের জমি। এমনকি রৌমারীর নতুন বন্দর স্থলবন্দর ও জেলার একমাত্র বাংলাদেশ-ভারত বালিয়ামারী সীমান্ত হাটও পানিতে তলিয়ে গেছে।
এ সময় কথা হয় মাদারটিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহিন আলমের সঙ্গে। সে জানায়, শ্রেণিকক্ষে বানের পানি ঢুকে পড়ায় স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে।
রৌমারী সদর ইউনিয়নের চরবারবান্ধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘স্কুলের চারপাশে পানি থাকায় ও রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসতে পারছে না। এ কারণে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।’
রৌমারী সদর ইউনিয়নের নতুন চুলিয়ারচর গ্রামের কৃষক ছক্কু মিয়া বলেন, ‘কোনো মতে জমি থেকে ধান কাটতে পারলেও খড় শুকাতে পারিনি। সব ভেসে গেছে। এখন গরুর মুখে দেয়ার মতো কোনো খড় নাই।’
পুরাতন যাদুরচর গ্রামের দিনমজুর সুরুজ্জামান বলেন, ‘টানা দেড় সপ্তাহ ধরে বৃষ্টিতে কাম-কাজ নাই। এর মধ্যে বন্যার পানিতে বাড়িঘর সব ডুবে গেছে। সন্তানদের নিয়ে খুব অসহায় হয়ে পড়েছি। সরকারের কোনো অনুদান আমরা পাচ্ছি না। চেয়ারম্যান-মেম্বার কেউ কোনো খোঁজ রাখেন না।’
কাশিয়াবাড়ী গ্রামের মাছ চাষি আবু সাঈদ। ঢলের পানিতে তার তিনটি পুকুরের পাড় ভেঙে চাষের সব মাছ বের হয়ে গেছে। এতে তার তিন লাখ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে বলে জানান।
যাদুরচর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সরবেশ আলী বলেন, ‘সোমবার পর্যন্ত পাহাড়ি ঢলে ইউনিয়নে অন্তত ২০০ বসতবাড়িতে পানি উঠেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ পৌঁছেনি। দ্রুত ত্রাণের ব্যবস্থা করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) জানানো হয়েছে।’
রৌমারী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আজিজুর রহমান জানান, বানের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।
রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুল আলম রাসেল বলেন, ‘জিআরের বরাদ্দ থেকে ৩ লাখ টাকার শুকনা খাবার কেনা হয়েছে। এগুলো দ্রুত পানিবন্দি মানুষের মধ্যে সরবরাহ করা হবে। আরও বরাদ্দের জন্য জেলা প্রশাসককে জানানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই বিতরণ করা হবে।’